নাচুনি তারায় জয়, আইনস্টাইনের জয়!!!

Spread the love
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন

করোনাকালে ঘুমের রুটিনটা পাল্টে গেছে। আগের মতো খুব ভোরে আর ওঠা হয়না। ফজরের নামাজের পর দিব্যি আর একটা ভাল ঘুম দেওয়া যায়। কিন্তু আজ শুক্রবার সকাল যেন তাড়াতাড়িই হলো। ঘুম ভেঙ্গে মনে হলো স্বপ্নের মধ্যে শাদাচুলোটারে দেখেছি। ঠান্ডামাথায় ভেবে দেখলাম স্বপ্নটা আসলেই ঠিক।
আমার স্বপ্নে হাজির হয়েছে খোদ আইনস্টাইন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। ঘটনাটা নতুন নয় কারণ আইনস্টাইনের সঙ্গে আমার খাতির ভালই আজ প্রায় ৩২-৩৩ বছর ধরে। এর আগেও কয়েকবার উপরে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে এসেছি। একদিন দেখলাম উনি মন খারাপ করে বসে আছেন। মাঝে মধ্যে খটকা লাগলে মেরিলিন মনরো’র সঙ্গে তার সম্পর্কের ব্যাপারেও কথা বলতে যাই। এই তো সেদিন একটা অঙ্কে তাঁর বেকুব হওয়া নিয়েও আমরা বেশ মজা পেয়েছি।
আজকে অবশ্য এসবের কোন বালাই নাই। আমি দেখলাম আইনস্টাইন আমার শিয়রে দাড়িয়ে হাসছেন। আমাকে বলছেন – মুনির মিয়া, ঘুমাইলে হবে? দেখো আবারও আমি জিতছি। ওঠো।

কী আর করা। মহামতি আইনস্টাইনের ধাক্কায় উঠে খোঁজ নিতে হলো।
আরে ঠিকই তো! ঘন্টা কয়েক আগে মিডিয়াগুলো রিপোর্ট করেছে এই বিষয়টা। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আবারও বিজয় অর্জিত হয়েছে। মানব ইতিহাসে সম্ভবত আর কোন তত্ত্বকে এতো পরীক্ষায় পড়তে হয় না। ১০০+ বছর ধরে এটা চলছে।
আপেক্ষিতার সাধারণতত্ত্বের মূল ব্যাপার হলো মহাকর্ষ সম্পর্কে ভাবনা। বলা হচ্ছে স্থানকাল এমনিতে মসৃণ থাকে। কিন্তু ভারী কোন বস্তু, তারা কিংবা কৃষ্ণবিবর থাকলে এর আশেপাশের স্থান-কাল বেঁকে যায়। ফলে এমন সব কিছু হয় যার যা আমরা ঠিক আগে বুঝিনি। যেমন দূরবরতী কোন তারার আলো যখন সূর্য পার হয়ে আমাদের কাছে এসে পৌছানোর পথে সর্যকে অতিক্রমের সময় সামান্য বেঁকে যায়।

 

১৯০৯ সালের সূর্যগ্রহণের সময় এটি আমরা হাতেনাতে দেখেছি। সে সময় স্যার আর্থার এডিংটন ব্রাজিলে গিয়ে এই প্রমাণটা জেনেছেনঅ

এখন ভাবেন, একটা অতিকায় কৃষ্ণবিবরকে কেন্দ্র করে যদি আর একটা তারা ঘুরতে থাকে তাহলে সেটির গতিপথ কী হবে? খুবই সোজা। প্রতি চক্করে কিন্তু তার যাত্রাপথটা আগের অবস্থা থেকে সামান্য সরে যাবে। নিচের ভিডিওটা দেখতে পারেন, তাহলে বোঝা যাবে।

 

দেখা যাচ্ছে, কৃষ্ণবিবরকে কেন্দ্র করে ঘুরছে যে তারাটি সেটার যাত্রাপথ বা কক্ষপথের অপসুর সামান্য করে সরছে। দূর থেকে ছবি আঁকতে পারেন তাহলে মনে হবে তারাটি নেচে চলেছে! কক্ষপথের এই যে সরণ এটিকে বলা হয় সোয়ার্চাইল্ড অগ্রগমণ। নিউটনের মহাকর্ষ ঠিক হলে এই সরণটা হতো না। তারা একটি স্থির কক্ষপথে আবর্তিত হতো। কিন্তু আইনস্টাইনের আপেক্ষিতার সাধারণ তত্ত্বে যেমনটি আছে তাই আসলে ঘটে।
আর সেটি্রই প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন ইউরোপিয়ান সাউদার্ণ অবজারভেটরির (ইএসও) নভোবিদেরা। গত ২৭ বছর ধরে তারা এসটু(S2) নামের আমাদের থেকে ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরের এই তারাটির ওপর নজর রেখে চলেছেন। তারাটি আমাদের গ্যালাক্সির মাঝখানে যে দানব কৃষ্ণবিবরটি আছে সেটির সাতপাঁকে বাধা পড়েছে। কৃষ্ণবিবরের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে তারাটির প্রায় ১৬ বছর লাগে। এসটু তারাটির মোটামুটি দুইটি আবর্তন (একটু কম) –এর হিসাব নিকাশ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন তারার এই নাচুনি বৈশিষ্ট্য যা আইনস্টাইনের সাধারণতত্ত্বকে আবারও মহিমান্বিত করেছে।  সেখানে আইনস্টাইন বলেছেন একটি বিশাল বড় বস্তুকে ঘিরে যদি একটি খুবই ছোট বস্ত পাক খায়, তাহলে ছোটটির আবর্তনপথ একটু একটু করে সামনে আগাবে। আইনস্টাইনের এই তত্ত্বের আগে আমরা ঠিকমতো বুধের আবর্তনপথের পরিবর্তন ব্যাখ্যা করতে পারতাম না। ফলে, ১৯১৬ সালের আগে বিজ্ঞানীরা সূর্য ও বুধের মাঝখানে ভালকান নামে একটি গ্রহের কথা কল্পনা করেন। কিন্তু সাধারণতত্ত্ব প্রকাশের পর দেখা যায় আইনস্টাইনের হিসাবে বুধের কক্ষপথের নাচের বিষয় সহজে ব্যাখ্যা করা যায়, ভালকানের দরকার হয় না। তবে, আমাদের দেশে এখনও অনেক জ্ঞানের বই-এ ভালকানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আমাদের পাঠ্যপুস্তকেও দীর্ঘদিন ভালকানের উপস্থিতি ছিল। বাধ্য হয়ে ১৯৭৪ সালে আমাদের জ্যেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞনী আবদুল জব্বার স্যার সেই সময়কার দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন – ভালকান পাঠ্যপুস্তকে আছে মহাকাশে নাই

সে যাকগে, কিছুক্ষণ আগে (পাশ্চাত্যের ১৬ এপ্রিল ২০২০, আমাদের ১৭ এপ্রিল ভোররাত) অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স জার্নালে এএসও-এর বিজ্ঞানীরা তাদের এই অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। জার্মানীর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর এক্সট্রাটেরেস্টিয়াল ফিজিক্সের পরিচালক রেইনহার্ড গেনজেল এই গবেষণার অন্যতম লেখক। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন -“Einstein’s general relativity predicts that bound orbits of one object around another are not closed, as in Newtonian gravity, but precess forward in the plane of motion, This famous effect — first seen in the orbit of the planet Mercury around the sun — was the first evidence in favor of general relativity. One hundred years later, we have now detected the same effect in the motion of a star orbiting the [black hole] at the center of the Milky Way.”

এই প্রথমবারের মতো সোয়ার্চাইল্ড অগ্রগমণের বিষয়টি কৃষ্ণবিবরকে কেন্দ্র করে ঘুর্ণায়মান কোন তারার বেলায় প্রমাণ হলো। চিলিতে অবস্থিত বৃহদকায় টেলিস্কোপ (ভিএলটি) ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এসটুর যাত্রাপথের প্রায় ৩০০টি অবস্থান চিহ্নিত করে এই গবেষণাটি সম্পন্ন করেছেন। আইনস্টাইনের বিজয়গাঁথা ঘোষণার পাশাপাশি এই গবেষণায় এরকম হিসাব সূক্ষ্ণভাবে করার ব্যাপারে আরও একধাপ এগিয়ে দিল মানবজাতিকে।

এরকম একটা ঘটনার পর আইনস্টাইনের পক্ষে, সে তিনি যেখানেই থাকুন, কি স্থির থাকা সম্ভব?

আমার মতো তাঁর ভক্তকুলকে জাগিয়ে দেওয়া ছাড়া তিনি আর কীইবা করতে পারেন।

 

Leave a Reply