শ্রদ্ধাঞ্জলি : যে অঙ্কে ‘বেকুব’ আইনস্টাইন!

Spread the love

১৪ মার্চ দিনটা আমার জন্য একটা বিশেষ দিন। জাফর ইকবাল স্যারকায়কোবাদ স্যারের পাল্লায় পড়ে, মতি ভাই-এর প্ররোচনায় গণিত অলিম্পিয়াড শুরুর দিকের কথা। সে সময় আমার একটা ধান্ধা ছিল কীভাবে নানা উছিলায় বছর জুড়ে গণিতের কিছু একটা করা যায়। সে হিসাবে প্রথম জানতে পারি পাই দিবসের কথা। আমেরিকান রীতিতে তারিখ লিখলে ১৪ মার্চ হয় ৩/১৪ যা কিনা পাই(π)-এর মানের প্রথম দুই ঘর। কাজে ২০০৩ সালের ১৪ মার্চ আমরা প্রথম পাই দিবস উপলক্ষে একটা শোভাযাত্রা বের করি যা কিনা জাদুঘরের সামনে থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত যায়। সেখানে ঢাবির গণিত বিভাগের নিচে পাই(কেক) কাটা। তারপর থেকে কোন না কোনভাবে আমরা এটা পালন করি।
সেরকমই কোন একবার আমরা খেয়াল করি, আরে ১৪ মার্চ তো আমাদের আইনস্টাইনের জন্মদিন!!! সঙ্গে সঙ্গে আমরা আনন্দিত হয়ে উঠি। আইনস্টাইনকে নিয়ে আমাদের নানা আয়োজন, নানা ঘটনা থাকে।

আমি প্রায়শ ওয়ার্মহোলদিয়ে বেচারা আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখাও করতে যাই। আইনস্টাইনের অবদান বিজ্ঞানে এতোবেশি যুগান্তকারী যে, শতবর্ষ আগে তাঁর কোন কোন ধারণা প্রমাণ করে এই দশকেও নোবেল পুরস্কার পাওয়া যায়। আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও এই মহাবিজ্ঞানীর একটি চমৎকার কথোপকথন আছে। সেখানে আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথ বরং দ্রষ্টা নিরপেক্ষ দুনিয়ার পক্ষে নন। সেটি অবশ্য আমরা তাঁর কবিতায় দেখতে পাই –আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/চুনি উঠল রাঙা হয়ে।/আমি চোখ মেললুম আকাশে,/জ্বলে উঠল আলো/পুবে পশ্চিমে।/গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম “সুন্দর’,/সুন্দর হল সে।/তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা,/ এ কবির বাণী নয়।/আমি বলব, এ সত্য,/তাই এ কাব্য।

তবে, ১৪ মার্চের সর্বশেষ দ্যোতনাটা ধরা পড়ে ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ। সেদিন সকালে আমি বাসায় শুয়ে আছি, হঠাৎ অফিস থেকে ফোন। সেলিম ভাই বললেন – মুনির ভাই। আপনার বস তো চলে গেছে! তো, তখনই আমার মনে পড়লো আমাদের কালের নায়ক স্টিফেন উইলিয়াম হকিং ধরাধামে এসেছেন গ্যালিলিওর প্রয়ান দিবসে। কাজে উনি যাবার জন্য আইনস্টাইনের জন্মদিনকেই বেঁছে নেবেন তাতে আর আশ্চর্য কী?

তো, আজ সেই ১৪ মার্চ। মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জন্মদিন, পাই দিবস এবং স্টিফেন উইলিয়াম হকিং-এর প্রয়ান দিবস। কাজে নানাভাবেই এই দিনটিকে স্মরণ করা যায়।

আমি ঠিক করেছি, এই দিনে আমার ওয়েবসাইটে শুরু করবো একটি নতুন বিভাগ – ধাঁধায় মোড়ানো অঙ্ক। ভোরের কাগজে থাকতে, সেটির ইষ্টিকুটুম পাতায় গল্পে গল্পে ধাঁধা নামে একটি কলাম লিখতে শুরু করি, সেই পাতার সেই সময়কার সম্পাদক মুন্নী সাহার প্ররোচনায়। পড়ে সেগুলো বই আকারে প্রকাশ হয়েছে একই নামে। অবসর প্রকাশণীর আলমগীর-এর পাল্লায় পড়ে সেটির সিকুয়েল লিখি “ধাঁধায় ধাঁধায় গল্প”। আর সবশেষে তাম্রলিপির রনির পরামর্শে লেখা হয় অঙ্কের ধাঁধা ধাঁধার অঙ্ক। তিনটি মিলে এখন একটিই গ্রন্থ, শেষেরটির নামে। আমার কাছে যে সব অভিভাবক জানতে চান ছোট ছেলেমেয়েদের কেমন করে গণিতে আগ্রহী করে তুলতে হবে, তাদেরকে আমি এই বইটি পড়ার পরামর্শ দেই।

আইনস্টাইনের জীবনী থেকে আমার অনেক লেসন আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো – সুপারভাইজর ছাড়া চিন্তা করতে পারা। ২০০৫ সালে আইনস্টাইনের সাড়া জাগানো তিনটে পেপারের মূল রহস্যই হলো সেই সময় তাঁর কোন সুপারভাইজর ছিল না। যদি থাকতো তাহলে সুপারভাইজররা তাঁকে এরকম ‘এবসার্ড’ চিন্তা করতেই দিতেন না। দুই নম্বর হলো মানুষ যা কিছু ভাল করে সেগুলো তাঁর যৌবনেই করে ফেলে। ২৫-২৬ বছর বয়সে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে আইনস্টাইন ছিলেন একজন বিপ্লবী। অথচ সেই আইনস্টাইন নিজের যখন ৫০ বছর বয়স তখন ২৫ ওয়ালাদের বিরুদ্ধে লাঠিসোটা নিয়ে নেমে পড়লেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বিরুদ্ধে নানা রকম প্রশ্ন তুলে সলভে সম্মেলনকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে গেলেন, ইপিআর প্যারাডক্সও তৈরি করে ফেললেন! যা হোক, পরে যখন বুঝলেন লাভ হবে না তখন ক্ষ্যামা দিলেন প্রকাশ্য বিরোধিতার। পরে ১৯৪১ সালে আইনস্টাইনের পরিচয় হলো মেরিলিন মনরোর সঙ্গে। আইনস্টাইন. মনরো আর হকিং-কে নিয়ে আমার একটি অগ্রন্থিত বই-এর কাজ চলমান আছে।

তো, আইনস্টাইনের কথা ভাবলেই আমাদের মনে যে ছবি ভেসে উঠে সেটি একটি দারুণ স্মার্ট লোকের। বিশেষ করে তাঁর গণিত প্রতিভা নিয়ে আমাদের মনে কোন সন্দেহই নাই। অথচ আজ তাঁর জন্মদিনে আমার মনে পড়ছে ১৯৯৪ সালে একটি সহজ সাধারণ প্রশ্নে আইনস্টাইনের বোকা বনে যাওয়ার ঘটনা। তা্ই ভাবলাম এই ছোট্ট সমস্যা দিয়ে আজ এই মহৎ দিনে আমার নতুন সিরিজের জন্ম হোক। ১৯৩৪ সালে আইনস্টাইনের মনোবিদ বন্ধু ম্যাক্স ওয়ের্থেইমার আইনস্টাইনকে একটা চিঠি লেখেন। সেখানে নিচের ধাঁধাটিও তিনি জুড়ে দেন।

একটি পাহাড়ে গাড়ি চালিয়ে ওঠা যায়। চট্টগ্রামের বাটালি হিলের মতো; আপনি গাড়ি চালিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উঠতে পারেন। তবে, এই পাহাড়টি বাটালি হিলের মতোন নয়। কারণ এটিতে সরাসরি উপরে উঠা যায়। মোট দূরত্ব হলো ১ মাইল। নামতেও এক মাইল। একটি পুরান দিনের গাড়ি নিয়ে এই পাহাড়ে চড়তে আর নামতে হবে। গাড়িটি পুরাতন কাজেই উপরে উঠার সময় সেটির সর্বোচ্চ গতিবেগ হয় ঘন্টায় ১৫ মাইল। কিন্তু নামার সময় এটি অনেক গতিতে নামতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, নামার সময় সেটির গতি কতো হলে, চড়াই-উৎরাই মিলে গাড়িটির গড় গতিবেগ হবে ঘন্টায় ৩০ মাইল। প্রশ্নটা সহজ, তাই না?

সালটা ১৯৩৪। তার মানে আইনস্টাইন তখন বিখ্যাত লোক। ই ইকোয়াল টু এমসি স্কোয়ার তখন সারা পৃথিবীর লোকের মুখে মুখে। আমি যখন ১৯৮৬ সালে বুয়েটে পড়তে আসি তখন বাঙলা একাডেমির পাশের একটি বিল্ডিং-এর দেওয়ালে এই সমীকরণটি লিখে রাখতে দেখেছি। পরে জেনেছি ঐটি পরমাণু শক্তি কেন্দ্র (গাধারা তথন এটিকে অফিসিয়ালি আনবিক শক্তি কেন্দ্র বলতো যদিও এটির ইংরেজি নাম এটমিক এনার্জি সেন্টারই ছিল)। কাজে এটি খুবই স্বাভাবিক যে, আইনস্টাইন এটি এক লহমায়করে ফেলবেন। কিন্তু দেখা গেল সেটি হলো না! কেন?

এই ধাঁধার উত্তর, প্রিয় পাঠক, আপনি বের করুন। আমি বরং আপনাকে আর একটা হিন্টস দেই। গণিত বিদ এরিক ভন নিউম্যানকে ঝামেলায় ফেলার জন্য একবার তাঁকে একটা জটিল অঙ্ক করতে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের মোত একটি দেশে একবার একই ট্রেন লাইনে দুইটি ট্রেন মুখোমুখি ঘন্টায় ৫০ মাইল গতিতে পরস্পরের দিকে এগোতে শুরু করলো, ১০০ মাইল দূর থেকে। ওদের যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে একটি মৌমাছি প্রথম ট্রেন ছুঁয়ে দ্বিতীয় ট্রেনের দিকে উড়তে শুরু করলো ঘন্টায় ৪০০ মাইল গতিতে। এরপর এটি দ্বিতীয় ট্রেনকে ছুঁয়ে আবার প্রথম ট্রেনের দিকে উড়ে গেল। এভাবে একবার প্রথম ট্রেন আর একবার দ্বিতীয় ট্রেন- এভাবে অসংখ্যবার উড়াউড়ি করলো মৌমাছি। শেষ পর্যন্ত ট্রেন দুইটির যখন মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো তখন তাদের চাপে পিষ্ট হয়ে মৌমাছিটির ভবলীলা সাঙ্গ হলো। প্রশ্ন হচ্ছে, মরার আগে মৌমাছিটি মোট কতদূরত্ব অতিক্রম করেছে?

ভন নিউম্যানের মতো চিন্তা করতে পারলে আপনি আইনস্টাইনের বেকুবিতে নিজে পড়বেন না।

প্রিয় পাঠক, আপনার চেষ্টা চলতে থাকুক। যারা পারলেন তারা সমাধানটা মিলিয়ে নিতে পারেন।

সমাধান

 

2 Replies to “শ্রদ্ধাঞ্জলি : যে অঙ্কে ‘বেকুব’ আইনস্টাইন!”

Leave a Reply