“Heroes get remembered, but legends never die.”

Spread the love
১৯৯২ সালের ১ জুলাই আমি বুয়েটের তখনকার কম্পিউটার সেন্টারে যোগ দেই। কম্পিউটার সেন্টারে তখন দুটো মেইনফ্রেম কম্পিউটার – আইবিএম ৪৩৩১ ও আইবিএম ৩৭০। সেগুলোর নানা কিছু। গোটা কতক এক্সটি পিসি আছে। তো, আমার কাজের একটা হলো এই আইবিএম কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। প্রথমত ওদের সঙ্গে আমাদের মেইনটেইন্যান্স চুক্তি আছে সেটা অনুসারে বিল দেওয়া। তখন দেখলাম আমাদের সেন্টারেই আইবিএমের জিনিষপত্র আছে, আলমিরা আছে। ফরিদ ভাই, মোশ্তাক ভাই, মাহবুব ভাই ওনারা আসেন। কিন্তু বিল-টিল বা যে কোন চিঠিপত্র সই করে যে লোক তার নামের শেষ বিপি লেখা। বিপি দিয়ে কী হতে পারে এটা আমি ভাবি। আমি একটা কিছু ভাবি কিন্তু তারপর ভাবি এই লোক কেন এখানে।
তো, এরই মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে। সেন্টারে আসলে আমাকে হ্যালো করে যেতেন কারণ ততোদিনে জেনে গেছেন সেন্টারের সব ফাইল আমি ইনিশিয়েট করি। এর মধ্যে একদিন সাহস করে জানতে চাইলাম – বিপি দিয়ে কী হয়?
পাল্টা প্রশ্ন করলেন- মুনির, আপনার কী মনে হয়?
আমি আমতা আমতা করে বললবাম- আমি বিপি দিয়ে কেবল বীর প্রতীক কথাটা জানি।
তিনি আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন – ঠিক তাই।
আমি বললবাম – আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধা! যুদ্ধ করেছেন!! স্বাধীনতা যুদ্ধ!!!
 
শাহজামান মজুমদার বীর প্রতীক হাসলেন।
 
আমি তো পেয়ে গেলাম একটা বড় কাজ। তখন পর্যন্ত আমি মাত্র একজন গ্যালান্টারি এওয়ার্ড পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাকে চিনি ক্যাপ্টেন (পরে কর্নেল) সালাউদ্দির বীর বিক্রম। কিন্তু খালু তাই একটু দূরবর্তী লোক। জামান ভাই রাতারাতি আমার প্রিয় মানুষ হয়ে গেলেন। কিছুদিনের মধ্যে উনি আবিস্কার করলেন – আমি কিছুই জানি না। কিছু বললেই শুধু হা করে তাকিয়ে থাকি। আমাকে পড়ানোর দায়িত্ব তিনি নিজে নিলেন। যতবারই বুয়েটে আসেন আমার একটা ক্লাস নেন। মেইনফ্রেম কম্পিউটার, তার আনুসঙ্গিক জিনিষপত্র। কিন্তু তার চেয়ে বড় বেশি হলো কম্পিউটার কী করতে পারে। উনি একটা অদ্ভুত জগতের কথা বলতেন যেখানে সবকিছু কম্পিউটার দিয়ে হয়। আমি ওনার দেওয়া হোমওয়ার্কগুলো করতাম। মোটা মোটা বই দিয়ে যেতেন। সেগুলো পড়া লাগতো। আমার দুটো টার্গেট। একটা হলো ওনার যুদ্ধের গল্প শোনা। আর একটা হলো আইবিএম সম্পর্কে জেনেটেনে নিজের কাজটা ঠিক মতো করতে পারা। দুটোতেই ওনার সাহায্য আমার দরকার।
 
শেষ পর্যন্ত উনি রাজি হলেন। এবং একদিন আমাদের পিসি ক্লাশরুমে তিনি আমাদের যুদ্ধের গল্প বললেন। জামান ভাই-এর বৈশিষ্ট্য ছিল ওনার কথা বলা। উনি যে কোন কিছুই অসাধারণভাবে বলতে পারতেন। কাজে যুদ্ধের গল্প বলার জন্য তিনি হোয়াইট বোর্ড ব্যবহার করলেন। সেখানে ছবি গ্রাফ আঁকলেন। পুরো কাহিনীর ফাঁকে নিজের বীরত্বের কথা চেপে গেলেন। কিন্তু আমি ততোদিনে যুদ্ধের অনেককিছু পড়ে ফেলেছি, যে সকল যুদ্ধের জন্য গ্যালান্টারি এওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে সেগুলোর প্যাটার্ন বুঝতে পারি। কাজে আমি ঠিকই ধরতে পেরেছি জামান ভাই-এর চেষ্টায় কেমন করে একটা পুরো ইউনিট সেদিন বেঁচে গিয়েছে।
তারপর থেকে জামান ভাই-এর পেছনে লেগেছিলাম কেন তিনি তাঁর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লিখেন না।
২০০৯ সালের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আমি আবিস্কার করলাম সে সময়ে বাংলাদেশের তিনটি আইটি এসোসিয়েশেন এবং এর মন্ত্রী সবাই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা জব্বার (বর্তমানে মন্ত্রী), বেসিসের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব জামান এবং আইএসপিএবির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা (প্রয়াত) মঞ্জু ভাই। আর মন্ত্রী হলেন বেতিয়ারা যুদ্ধের অন্যতম সারভাইভার বীর মুক্তিযোদ্ধা স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। তখন আমরা একটা অনুৃষ্ঠান করলাম যেখানে ওনারা চারজন এবং সঙ্গে জামান ভাই, বীরেন্দ্র অধিকারী স্মৃতিচারণ করেন।
১৯৭১ সালে জামান ভাই-এর বয়স সম্ভবত ১৪ ছিল!!! পরে তিনি তার যুদ্ধকাহিনী প্রকাশ করেন দ্যা গেরিলা নামে। এই কিশোর শাহজামান মজুমদার বীর প্রতীকের মতো অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের এই স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। তাদের জন্য শ্রদ্ধা।
 
জামান ভাই ছিল “কিং অব ঢাকা।” তার ছিল এলগ্যান্ট স্টাইল।
শাহজামান মজুমদার বীর প্রতীক আপনি সবসময় আমার স্মৃতিতে থাকবেন।
আল্লাহ আপনাকে বেহেস্ত নসীব করুন।

Leave a Reply