নিউরনে অনুরণন থেকে সোনার পদক

Spread the love

১৩ জুলাই ২০১৮। শুক্রবার। দুপুর ১২টার মধ্যে আমাদের হোটেল বেলভেদর থেকে চেক আউট করতে হয়েছে। বাক্স-প্যাটরা হোটেলের রিসেপশনে রেখে আমরা গিয়েছি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের (আইএমও) সমাপনী অনুষ্ঠানে। সেই ২০০৪ সাল থেকে আমি এই অনুষ্ঠানে যাই। ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড আর প্রথম আলোর কল্যানে এ অনুষ্ঠানে আমার দেড় দশক হয়ে গেল। তবে, এবারের অনুভূতি সম্পূর্ণ আলাদা।

গণিত অলিম্পিয়াডের সমাপনী অন্যরকম। আমাদের গণিত উৎসবে যারা যান তারা অবশ্য পরিবেশটার সঙ্গে পরিচিত। এখানে সামনের কাতারের সব চেয়ারে খুদে গণিতবিদরাই বসে থাকে! আইওমওতে বসানো হয় মেরিট পজিশন অনুসারে। এবারে বসানো হয়েছে দুইটি কলামে, অনেকগুলো সারিতে। আর তিন নম্বর সারিতে জায়গা হয়েছে আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরীর।

আমি, রাহুল (রাহুল সাহা) ও সৌমিত্র দাশ বসেছি ইনডোর স্টেডিয়ামের দর্শক গ্যালারিতে, মঞ্চ থেকে অনেক দূরে। আমাদের গাইড ভ্লাদ আদ্রিয়ানকে রুবাবের ফোন দিয়ে আমরা ভলান্টিয়ারদের সারিতে পাঠালাম, ছবি তোলার জন্য। কিছুক্ষণ পরে আদ্রিয়ান এসে বললো তার বাসায় ঝামেলা হয়েছে, ও চলে যাচ্ছে। রুবারের ফোন ফেরৎ দিয়ে গেল। সেটা নিয়ে রাহুলকে পাঠালাম দর্শকদের সারির সামনের দিকে যাতে পদক নেওয়ার সময় ছবি তোলা যায়।

আমার কী আর মনে টেকে। একটু পরে খুঁজতে গেলাম রাহুলকে। গিয়ে নিজেও দাড়িয়ে গেলাম ছবি তুলতে। জাওয়াদের পালা আসল, ও আসন থেকে উঠলো তখন প্রথম ছবিটা তুলেছি, তারপর দ্বিতীয়টা। তারপরই কেমন করে যেন আমার হাত চলে গেল ভিডিও বাটনে!

অন্যান্যবারের মতো ঠান্ডা মাথায় অনুষ্ঠান দেখা বা পরের আইএমওর দাওয়াত নেওয়া এগুলো কিছুই এবার হয়নি। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই আমরা বের হয়ে পড়েছি কারণ আমাদের ফিরতি বিমান ধরতে হবে।

বিমান বন্দরে যেতে যেতে আমার মনে পড়লো ২০০১ সালের এপ্রিল মাসের কোন একদিনের কথা। বুয়েটে থেকে বের হয়ে বিকেলে কোন কোন দিন প্রথম আলো অফিসে যাই। সাপ্তাহিক বিজ্ঞানের পাতার দায়িত্ব পালন করতে। সেদিন গিয়ে শুনি সম্পাদক মতি ভাই (মতিউর রহমান) আমাকে দেখা করতে বলেছেন। দেখা করার পর বললেন – তোমার দুই স্যার আসছেন (জাফর স্যার ও কায়কোবাদ স্যার)। প্রথম আলো’তে গণিত অলিম্পিকের (মতিভাই এখনো মাঝে মধ্যে গণিত অলিম্পিক বলেন) জন্য জায়গা চান। আমি তোমার কথা আর তোমার পাতার কথা বলে দিয়েছি। ওনারা যেভাবে চান সেভাবে শুরু করে দাও।

তো, সে শুরুটা করতে আমাদের মাস দেড়েক লাগলো। এর মধ্যে প্রতি শুক্রবার ভোরবেলা কায়কোবাদ স্যার আমার এলিফেন্ট রোডের নিচতলার বাসায় আসেন। তারপর আমি আর স্যার মিলে যাই জাফর স্যারের বাসায়।

মতি ভাই-এর সঙ্গে আলাপের পরের সপ্তাহ থেকে আমাদের আলাপের বিষয়বস্তু হলো প্রথম আলো’তে কীভাবে কাজটা শুরু হবে, নামটা কী হবে।

কয়েকবারের আলাপের পর ঠিক হলো প্রতি সপ্তাহে আমরা ৫টি গাণিতিক সমস্যা ছাপাবো। তারপরই লাগলো গ্যাঞ্জাম। আমি বললাম এক সপ্তাহে যে সমস্যা ছাপবো পরের সপ্তাহে সেগুলোর সমাধান ছাপিয়ে দেবো। বেঁকে বসলেন জাফর স্যার। বললেন – সমাধান কখনো ছাপানো যাবে না। আমি বললাম- তাহলে যারা সমাধান করবে তারা কেমনে জানবে সেটা ঠিক হলো কেমনে। জাফর স্যার তাৎক্ষণিকভাবে বললেন – তারা পোস্টকার্ডে উত্তর লিখে প্রথম আলো অফিসে পাঠিয়ে দেবে। তারপর তোমরা হিসাব রাখবে! শেষের কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করে।

আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। দিব্য চোখে দেখতে পেলাম ১০০/২০০ পোস্ট কার্ড প্রতিসপ্তাহে আমার টেবিলে পড়ে আছে! আর আমার বৃহস্পতি/শুক্রবারের ছুটির দিন চলে যাচ্ছে পোস্টকার্ড পড়ে পড়ে, সমাধান চেক করে। ঐদিন কোন সমাধান হলো না। ক্লাসের সময় হওয়াতে কায়কোবাদ স্যার আর আমি উঠে পড়লাম। যথারীতি স্যারকে নামিয়ে দিয়ে আমি বাসায় ফিরলাম।

সে সময় আমার শুক্রবারের রুটিন ছিল দুপুরে কাওরান বাজারে প্রথম আলো অফিসে গিয়ে পাতার পেস্টিং করা (তখন মেকাপ হতো কাগজে, আর পেস্টিং পাতলা পলিথিনে)। সেদিন পাতার পেস্টিং শেষ হতে না হতে দেখলাম মতি ভাই এসেছেন। আমাকে দেখে বললেন – গণিত অলিম্পিকের কী হলো?

বললাম – আগাচ্ছে। তারপর সব খুলে বললাম। শেষে বললাম – জাফর স্যার বলেছেন সমাধান কখনো ছাপা হবে না। যারা করবে তারা সমাধান পোস্টকার্ডে প্রথম আলো অফিসে পাঠাবে। আর আমরা সমাধান চেক করবো, তাপর আবার পোস্টকার্ড লিখে তাকে জানাবো যে তার কোনটা কোনটা সঠিক হয়েছে।

মতি ভাই বললেন – তো, শুরু করে দাও।

আমি আমতা আমতা করে বললাম – সপ্তাহে যদি ১০০ পোস্টকার্ডও আসে, এগুলো আমি কেমনে পড়বো, কেমনে হিসাব রাখবো, আবার পোস্ট কার্ডে জবাব দেবো?

মতি ভাই সঙ্গে সঙ্গে একটা সমাধান দিয়ে দিলেন – মিয়া, এই বুদ্ধিও নাই! তোমার সঙ্গে পাতায় কাজ করে এমন লোকজন আছে না। এরকম একজনকে তুমি আলাদা করে এ দায়িত্ব দিয়ে দাও। ওর কাজ হবে এটা করা! যাও দেরি করো না শুরু করে দাও।

পরের সপ্তাহে, কায়কোবাদ স্যারের সঙ্গে জাফর স্যারের কাকলির বাসায় গিয়ে মতি ভাই-এর প্রস্তাব বললাম। স্যাররা সব শুনে রাজি হলেন। তারপর ভিতরের ঘরে গিয়ে জাফর স্যার একটা কাগজ নিয়ে আসলেন। এটি একটি বিয়ের কার্ডের পেছনের অংশে লেখা (স্যার বললেন – খাবার টেবিলে বসে নাস্তা করতে করতে পাঁচটা প্রবলেম লিখেছি। কাগজের জন্য অপেক্ষা করিনি!)। দেখি সেখানে ১ নম্বরে রয়েছে ভালুকের গায়ের রঙের সমস্যাটা!!! নামও ঠিক হলো – নিউরনে অনুরণ!

যাহোক, পরের সপ্তাহে আমি কম্পোজ করিয়ে একটা মেকআপ করালাম। অশোক কর্মকার একটা লোগো করে দিলেন। পরের শুক্রবার সেটা স্যারদের দেখালাম। তারপর সেটা নিয়ে আমি গেলাম সম্পাদকের দপ্তরে। মতি ভাই বললেন, ঠিক আছে। খালি একবার সাজ্জাদ (সাজ্জাদ শরীফ) কে দেখিয়ে নাও।

তো, গেলাম। সাজ্জাদ ভাই বললে – অনুরণ তো মনে হয় কোন শব্দ নাই। নিউরণের সঙ্গে মিল আছে কিন্তু শব্দ মনে হয় ঠিক না।

তারপর বললেন – তুমি স্যারদের কাছ থেকে জানো, এ নামের তাৎপর্য কি।

আমি জাফর স্যারকে ফোন দিলাম। স্যার বললেন – আমাদের এ সমস্যা ছাপানোর লক্ষ্য হচ্ছে যারা এগুলো পড়বে তাদের মস্তিস্কে যে নিউরণগুলো আছে তাতে উত্তেজণা তৈরি করা, যাতে নিউরনে নিউরনে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
সাজ্জাদ ভাই বললেন ডিকশনারি দেখতে। দেখলাম শব্দটা অনুরণ নয়, অনুরণন। তো এমন করতে করতে সে সপ্তাহে এটি চালু হলো না। পরের সপ্তাহে , ২০০১ সালের ১৭ জুন, প্রথম আলোর বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতায় চালু হয়ে গেল বিশ্বের ইতিহাসের অভিনব গণিত অলিম্পিয়াড – নিউরনে অনুরণন। আর আমার সঙ্গে এসে যোগ দিল মুসা ইব্রাহিম (আমাদের প্রথম এভারেস্ট জয়ী)। ওর কাজ হলো উত্তরের হিসাব রাখা এবং ব্যাপারটা মেইনটেইন করা।

আমার হিসাব ভুল প্রমাণ করে প্রথম সপ্তাহে আমরা পোস্টকার্ড পেলাম মাত্র দেড় হাজার!!! তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে আমাদের নিউরনে অনুরণন ছাপা হয়। কয়েকটা সংখ্যা পর থেকে আমরা এর পরিচালক হিসাবে জাফর স্যার আর কায়কোবাদ স্যারের নামও ছাপাতে শুরু করলাম লোগোতে।
ছাপা হতে থাকলো বিজ্ঞান প্রজন্মের লিডের পাশে, ৬ষ্ঠ ও ৭ম কলামে, ডিসি ম্যাটার হিসাবে। দেখা গেল মেকাপের ছন্দ ঠিক রাখতে হলে প্রতি সংখ্যাতে কিছু খালি জায়গা থেকে যাচ্ছে যাতে গণিত নিয়ে কিছু থাকা দরকার। সে জায়গাটা আমি লিখতে শুরু করলাম কিছু মজার ঘটনা এবং আমার একটা ‘উইশ লিস্ট’। যেমন একদিন লিখলাম আমাদের থাকবে একটা গণিতের গাড়ি। আমরা এক শহর থেকে অন্য শহরে যাচ্ছি ঐ গাড়িতে করে আর গিয়ে সেখানে গণিত অলিম্পিয়াড করছি। তখনও জানতাম না মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেটা সত্যি হবে।

পেপার থেকে মাঠে

আমাদের নিউরনে অনুরণের ২০ এপিসোডের পর আমরা একটা বিশেষ সংখ্যা করেছি – অন্যরকম সেঞ্চুরি শিরোনামে। এর মধ্যে শুক্রবার সকালে  আমার আর কায়কোবাদ স্যারের যাওয়া হয় জাফর স্যারের বাসায়। সেখানে বসে আমরা ঠিক করলাম আচ্ছা একটা মিনি অলিম্পিয়াড করলে কেমন হয়।  ভালই হয়। কিন্তু খরচা-পাতি?

গেলাম মতি ভাই-এর কাছে। বললেন, আমাদের ৯ তলায় করে ফেল।
ব্যাস, ২৬ জানুয়ারি, ২০০২ সালে, সিএ ভবনের অডিটোরিয়ামে আমরা প্রথম মিনি অলিম্পিয়াড করলাম। খুব একটা সহজে হয়নি। প্রথমে খাতা দেখবে কে? মনে পড়লো বিজ্ঞান বক্তা আসিফ ও তার ডিসকাশন প্রজেক্টের কথা। তারপর খেয়াল হলো অংশগ্রহণকারী পাবো কই? কেও তো গণিত অলিম্পিয়াডের নামই শোনেনি, আসবে কেন।
বিপদতাড়িনি হিসাবে কোথা থেকে উদয় হলো ফারহানা আলম (স্বর্না)। আমাদের প্রথম আলোর প্রদায়ক এবং ভিকারুন্নিসা স্কুল ও কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী। ওর সঙ্গে গেলাম কলেজের রোকাইয়া ম্যাডামের কাছে। ম্যাডামের পারমিশন নিয়ে স্বর্ণা দৌড়ালো স্কুলের মেয়েদের বাসায়। এটা দেখে আমিও অনুপ্রাণিত হলাম। নিজেই গেলাম কিছু অভিভাবকের কাছে। বললাম – আপনার ছেলে/মেয়েকে সারাদিনের জন্য আমাদের কাছে দেন। বিকেলে পৌঁছে দিয়ে যাবো।
সে অনুষ্ঠানে কুমিল্রার চৌদ্দগ্রাম থেকে একটা ছেলে এসে পিছনে দাড়িয়ে থাকলো। খুলনা থেকে হারুনুর রশীদ স্যার আসলেন। আর আমাদের আগেই মিলনায়তেন এসে হাজির হলেন প্রফোসর গৌরাঙ্গ দেব রায়, শাবিপ্রবির গণিত বিভাগের প্রফেসর।
সেদিন অনুষ্ঠানের শেষে গৌরাঙ্গ স্যার ঘোষণা করলে শাবিপ্রবিতে হবে দেশের প্রথম জাতীয় ভিত্তিক গণিত অলিম্পিয়াড।

আমি আর আসিফ মিলে ততোক্ষণে পরিকল্পনা করেছি ইনডোর থেকে আউটডোরে আমরা চলে যাবো। ১৬ ফেব্রুয়ারি নারায়নগঞ্জে আমরা করে ফেললাম প্রথম বিজ্ঞান উৎসব। এ উৎসব করার জন্য বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির ব্যানার ব্যবহার করলাম। এরপর ১৯ এপ্রিল ফরিদুর রহমান পান্থ তার রাজবাড়িতে করলো দ্বিতীয় আয়োজন আরও বড়ো আকারে এবং শেষ পর্যন্ত ৪ঠা সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে আমরা করলাম চট্টগ্রাম গণিত উৎসব। দৃষ্টি চট্টগ্রাম আমাকে সহায়তা করলো। এ কয়টা করেই আমরা বুঝে ফেললাম কীভাবে গণিত অলিম্পিয়াড করতে হবে।

কাজে ২০০৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আর ১ ফেব্রুয়ারি আমরা প্রথম গণিত অলিম্পিয়াড করতে সক্ষম হলাম শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ফেরার পর ১৩ এপ্রিল গঠিত হলো বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।

অলিম্পিয়াড থেকে উৎসব
এরপর আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলো ডাচ বাংলা ব্যাংক। আমরা শুরু করলাম বড়ো আকারে গণিত উৎসব, দেশ জুড়ে। জুন মাসের গরম উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা জড়ো হলো মাঠে। অন্যদিকে নটরডেম কলেজের দ্বিতীয় দিনের শুরুতে ঢাকা শহর ডুবে গেল পানির নিচে!!! তারপরও উৎসব হলো। সিএ ভবনের অলিম্পিয়াডটা উপস্থাপনা করেছে স্বর্ণা। কিন্তু ঢাকার বাইরের উৎসবগুলোতে তাকে কই পাবো। কোন কিছু না ভেবে আমি দাড়িয়ে গেলাম মাইক্রোফোনের সামনে, ভুল উচ্চারণ আর চাঁটগাইয়া টানসহ শুরু করে দিলাম আমার মতো উপস্থাপনা।

সবকিছু থেকে আমি শিখি। খাতা দেখার দায়িত্ব দিয়েছিলাম ঢাকার নামকরা কিছু স্কুলের কয়েকজন শিক্ষককে। ওনাদের দেখে দেওয়া খাতা যাচাই করতে বসলেন জাফর স্যাররা পরদিন সকালে এবং ঘোষণা করলেন ওনারা সব খাতা দেখবেন। শেষমেষ দেখাগেল স্কুলের স্যাররা কেবল ১০ আর ০ দিয়েছেন, কোন পার্শিয়াল নম্বর দেননি। আর জাফর স্যারদের হাতে ৫৮ হয়ে গেল ৯৩! আমি বুঝলাম আমার একটা আলাদা একাডেমিক টিম লাগবে। সেবার এথেন্স গিয়ে আইএমওর সদস্যপদ নিয়ে আসলাম।
এর মধ্যে একদিন বসে আছি আমার বুয়েটের চেম্বারে। ছোটখাটো গড়নের একটি ছেলে আমার কাছে আসলো। জানালো ও বুয়েটেরই। গণিত অলিম্পিয়াডে কাজ করতে চায়। আমার মাথার মধ্যে একাডেমিক টিম। বললাম – লেগে যাও। এটা তোমারই উৎসব। তাৎক্ষণিকভাবে একাডেমিক টিম গড়ার দায়িত্ব নিয়ে নিল মাহমুদুল হাসান সোহাগ (এখন অন্যরকম গ্রুপের চেয়ারম্যান)।
একাডেমিক টিমতো হলো, লজিস্টিকের কী হবে। হিটলার এ হালিম ছিল আমার বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতার প্রধান প্রদায়ক। প্রথম কাজটা সে করলো। হিটলারের চাকরি হয়ে যাওয়ার পর ফরিদুর রহমান পান্থ দায়িত্ব নিলো। সে সময় আমাদের গাড়ি এক শহর থেকে এক শহরে যেতো তখন মোটামতো একটি ছেলে হয়ে গেল ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজার। এ ছেলেটি নিজে থেকে এসে যুক্ত হয়েছে গণিত অলিম্পিয়াডের সঙ্গে। চৌদ্দগ্রাম থেকে আসা ছেলেটির নাম ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ নবী।  আমি মোটামুটি নিশ্চিত কাজের বিস্তার নিয়ে।

ড. মাহবুব মজুমদারের যোগদান

২০০৫ সালের উৎসবের সময় জাফর স্যার আমাকে একজন সাধাসিধে ছেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ড. মাহবুব মজুমদার। শুনলাম তার অনেক আগ্রহ আছে গণিত অলিম্পিয়াড নিয়ে। আমেরিকায় থাকতে সে নিজেও বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছে। এর কয়েকদিন আগে আমি আরএজন পাটনাম কম্পিটিশনের একজনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে প্রচুর হতাশ হয়ে আছি। তবুও আমরা মাহবুবকে সঙ্গে নিলাম। মাহবুব আমার সঙ্গে ঢাকার বাইরেও গেল। আমরা প্রথম গণিত ক্যাম্পের আয়োজন করলাম। ফরিদা আখতার বানু ম্যাডাম দায়িত্ব নিলেন ক্যাম্পের। মাত্র তিন দিনের ক্যাম্প। শেষদিন আধাবেলা মাহবুবের সঙ্গে ক্যাম্পারদের দেখা হল।

গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির মিটিং-এ আমি প্রস্তাব করলাম মাহবুব আমাদের সঙ্গে যাক লিডার হিসেবে। কিন্তু বাধ সাধলেন একজন। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো অধ্যাপক মুনিবুর রহমান চৌধুরী যাবেন লিডার হিসেবে। আমি তো রইলাম ডেপুটি হিসাবে, টিমের সঙ্গে!

তো, ৭২ ঘন্টার সেই জার্নিতে আমি পেয়ে গেলাম আমার পরের বছরের রসদ। সব বাচ্চারা বললো – মাহবুব স্যারকেই তাদের মনে হয়েছে এই ক্যাম্পের জন্য উপযুক্ত লোক!
মেক্সিকোতে আমরা মোট পেলাম ৩ পয়েন্ট। তখন ফেসবুক ছিল না। বাংলা আইটি নামে একটি ইয়াহু গ্রুপ ছিল। একদিন ঢুকে দেখি সেখানে বিভিন্ন লোক আমরা কল্লা কেটে ফেলছে। কারণ ‘আমি গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ টিম নিয়ে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছি’।

অন্যরকম কৌশল
২০০৬ সালের আইএমও হবে স্লোভেনিয়ায়। আমরা যথারীতি ক্যাম্পের আয়োজন করলাম। পুরো ক্যাম্পের দায়িত্ব দিয়ে দিলাম মাহবুবকে। ক্লাসের দায়িত্ব নিলো সোহাগের নেতৃত্বে বুয়েটের ছেলে-মেয়েরা। তখন ক্যাম্পে সবাইকে স্বাগত জানানোর একটা রীতি ছিল। কমিটির পক্ষে আমি সেটা করতাম। ক্যাম্প শুরু হতো বিকেলে। সন্ধ্যার মধ্যে রিপোর্টিং। তারপর আমার বক্তৃতা, পরিচিতি পর্ব এবং ঘুমাতে যাওয়া। পরদিন সকাল থেকে গণিত!

তো, আমি হাজির হলাম ইস্কাটনের লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সবাই খেয়ে দেয়ে নিজেদের রুমে চলে গেল। আর আমি প্রথম দেখলাম ক্যাম্পের রুটিন। দেখলাম ওখানে কেবল জ্যামিতি, জ্যামিতি, জ্যামিতি!!!

মাহবুব আমাকে জানালো আমাদের প্রথম স্ট্র্যাটেজি হবে যে কোন একজনের একটি সমস্যা সমাধান করা। আর আমাদের জ্যামিতি সিলেবাস যেমন ভাল তেমনি আমাদের ছেলে-মেয়েরা জ্যামিতিতে ভাল। কাজে আমাদের প্রথম জোর দিতে হবে জ্যামিতিতে। মাহবুবের হিসাবে আমরা প্রথম একটা সমস্যার সমাধান করতে পারবো ২০০৭ সালে।

তো, জ্যামিতির জন্য মাহবুব কিছু বই নিয়ে আসলো। জ্যামিতি আনবাউন্ড আর জ্যামিতি রিভিজিটেড। তো, শুরু হয়ে গেল আমাদের নতুন অভিযাত্রা।
সে বছরে মাহবুব দলনেতা হিসেবে গেল। আমি ডেপুটি হিসাবে, যথারীতি। সেবার থেকে শুরু হলো আমার আর মাহবুবের গণিত অলিম্পিয়াডের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করার বাৎসরিক মিটিং –  আইএমওতে, প্রতিযোগীদের খাতা দেখতে দেখতে।

মাহবুবের স্ট্র্যাটেজি ছিল সহজ। আমি যদি স্টেপ বাই স্টেপ লিখি তাহলে এটা এভাবে লেখা যাবে-

  • যে কোন একজন একটি সমস্যার সমাধান করতে পারবে
  • কয়েকজন একটি সমস্যার সমাধান করতে পারবে
  • ১/২জন দ্বিতীয় একটি সমস্যার সমাধান করতে পারবে
  • সবাই দ্বিতীয় সমস্যা থেকে কিছু পার্শিয়াল নম্বর যোগাড় করতে পারবে
  • দলীয় স্কোর ১০০ অতিক্রম করবে
  • পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ভারতকে হারাবো
  • গোল্ড পাইলেও পাইতে পারি

এভাবে আমরা ধাপে ধাপে পৌছে গেলাম সোনার দরবারে। আমাদের দলের পারফরম্যান্সের গ্রাফ দেখলে মাহবুবের স্ট্র্যাটেজির ফলাফলটা দেখা যাবে।

 

জ্যামিতির ব্যাপারটা মাহবুব কতো ভালভাবে বুঝেছে সেটা বোঝা যাবে ২০১৮ সালের ইরানিয়ান জিওমেট্রি অলিম্পিয়াডের ফলাফল দেখলে। সেখানে আমাদের একটা স্বর্ণপদক, কয়েকটা করে রূপা আর ব্রোঞ্চ। ৫টি সমস্যার নিঁখুত সমাধান করে আমাদের জয়দীপ সাহার পারফেক্ট স্কোর। ৫৬টি দেশ থেকে পার্টিসিপেন্ট ছিল সেখানে। 

আইএমও স্বর্ণ পদক

আইএমও-র স্বর্ণপদক কেমন সেটা বোঝার জন্য কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যেতে পারে। ১৯৫৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৩৭টি দেশ বা টেরিটরি আইএমওতে অংশ নিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোস্লাভাকিয়া, যুগোস্লাভাকিয়া এসব দেশ ভেঙ্গে এখন অনেক দেশ হয়েছে। আবার  কোন কোনটির এখন আর অস্থিত্ব নেই। ৫৯টি আইএমওতে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৪৮১টি স্বর্ণ পদক দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ ১০টি দেশ নিয়ে গেছে ৮৬৯টি!!!

এগুলো হলো বুলগেরিয়া, চিন, পূর্ব জার্মানী (এখন নেই), জার্মানী, হাঙ্গেরী, দক্ষিণ কোরিয়া, রোমানিয়া, রাশিয়া ফেডারেশন, আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন (এখন নেই) ও ভিয়েতনাম। এদের প্রত্যেকরই ৫০ বা তার চেয়ে বেশি স্বর্ণ পদক আছে। এর মধ্যে চিনের ১৫১টি আর আমেরিকার ১২৪টি। বাকী ৬১২টি স্বর্ণ পদক পেয়েছে ৫৬টি দেশ। তার মানে এখন পর্যন্ত ৭১টি দেশ একটি সোনার পদকও পায়নি।
ফিল্ডস মেডালকে ধরা হয় গণিতের নোবেল পুরস্কার। প্রতি চারবছর অন্তর এই পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৭৮ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যতোজন ফিল্ড মেডাল পেয়েছে তাদের এক-তৃতীয়াংশই কিন্তু আইএমও-র গোল্ড মেডালিস্ট।

আগের তুলনায় বর্তমানে গোল্ড মেডেল পাওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে গেছে মূলত চিন, আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়ার কারনে। ইদানীং এদের দলের প্রায় সবাই স্বর্ণ পদক পায়। যেমন ডেনমার্ক ২০১০ সালে একটি স্বর্ণপদক পেয়েছে আর পায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের একমাত্র স্বর্ণ পদক পেয়েছে ১৯৯৭ সালে। ভারতের ১১টি স্বর্ণ পদকের ৮টি ২০০২ সালের আগের। এরপর ২০১১ ও ২০১২ সালে তারা মোট তিনটি স্বর্ণ পদক পেয়েছে। যেহেতু আইএমওতে মোট স্বর্ণপদকের সংখ্যা খুব একটা হেরফের হয় না, সে জন্য স্বর্ণপদকের বেশিরভাগ নিয়ে যায় শীর্ষ ১০ দেশের প্রতিযোগীরা। শীর্ষ দশে এখন পূর্ব জার্মানি আর সোভিয়েত ইউনিয়ানের জায়গা দখল করেছে যুক্তরাজ্য ও ইরান। এ কারণে গড়ে ৪০-৪৮ জনের মধ্যে এদেরই থাকে ৩০-৩৫ জন। বাকী কয়েকটা থাকে অন্যান্য দেশের জন্য। এতে বোঝা য়ায়, স্বর্ণ পদকের লড়াইটা কেমন হয়।

পরের ধাপ
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে সোনার পদক জেতার পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্যগুলো আমরা ঠিক করেছি। এর মধ্যে প্রথমটি হলো আমাদের গণিত ক্যাম্পের ব্যাপ্তি বাড়ানো। বর্তমানে জাতীয় উৎসবের সেরা ৪০ জনকে আমরা ক্যাম্পের সুযোগ দেই। আগামীদিনগুলোতে আঞ্চলিক ক্যাম্পের মাধ্যমে আমরা এই সংখ্যা ৪০০ জনে উন্নীত করতে চাই। এর পাশাপাশি চালু হবে মেয়েদের জন্য আলাদা গণিত অলিম্পিয়াড যাদের থেকে বাংলাদেশের মেয়েদের দল যাবে ইউরোপীয় গার্লস ম্যাথ অলিম্পিয়াডে। এছাড়া একাধিক দলকে আমরা অন্যান্য আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে পাঠাবো বলে চিন্তা করছি।

এসব কিছু সম্ভব হবে যদি আমাদের শিক্ষার্থীরা গণিতের মূল চ্যালেঞ্জে আগ্রহী হয়।


[মাসিক বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত]

 

 

 

Leave a Reply