ধাঁধায় মোড়ানো গণিত -১: শুরুর শুরু

Spread the love

আমার দাদা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। কিন্তু দাদী, নাছিমা আখতার, ছিলেন ধনীঘরের একমাত্র মেয়ে, আদরের। ছোটবেলা থেকে যা চেয়েছেন, পেয়েছেন। দাদার সংসারে সীমিত টাকাতে সংসার চালাতে গিয়ে নানান বুদ্ধি শিখে ফেলেছিলেন। ধাঁধা নিয়ে আমার যে আগ্রহ কিংবা কৌতুহল সেটির জন্ম দাদীর হাতেই। তাঁর কাছেই আমি আমার জীবনের প্রথম ধাঁধাটি শুনি। স্বভাবতই সেটি চাটগাঁর ভাষায়।

এক.
তারা বাপ-পুত, তারা বাপ-পুত
তালতলা দি যায়
তিননো তাল ফড়ি রইয়ি
জনে উউগগা ফায়

মানে হলো দুই জোড়া বাবা-ছেলে তাল গাছের নিচে দিয়ে যাওয়ার সময় মাটি থেকে তিনটি তাল কুড়িয়ে পেয়েছে, আবার সবাই একটা করেও পেয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব?

দাদীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে করতে একটি বিষয়কে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চোখ তৈরি হতে থাকে। তবে শেষ পর্যন্ত দাদীর মতো চোখ আর আমার হয়নি। পরে যখন ধাঁধা নিয়ে পড়ালেখা শুরু করি তখন জানতে পারি, এই ধাঁধাটি বিশ্বের প্রায় সব দেশেই প্রচলিত। যেমন জাপানে এই ধাঁধাটিতে বলা হয় দুই জোড়া মা-মেয়ের কথা।

আমাদের দেশেও অনেক চমৎকার ধাঁধা আছে। দু:খ হলো আমাদের কোন স্যাম লয়েড বা হেনরি ড্যুডনি না থাকায় সেগুলোর কোন আন্তর্জাতিক সংস্করণ হয়নি। দাদীর সঙ্গে থাকতে থাকতে আমিও মাঝেমধ্যে কিছু ধাঁধা তৈরি করার চেষ্টা করতাম। লোকজনকে বোকা বানানোর জন্য আমার একটি বানানো একটি ছিল খুবই সহজ।

দুই
একটি বহুতলা ভবনের দোতলায় উঠতে দুইটি সিড়ি লাগলে
তিনতলায় উঠতে কয়টি সিড়ি লাগবে?

এটি আমি সবাইকে এতো বেশি বলতাম যে, আমার চেয়ে বয়সে ছোট কোন কোন কাজিন আমাকে দেখলেই সুর করে বলতো- দোতলায় উঠতে দুইটি সিড়ি লাগে!!!

এভাবে ধাঁধার ব্যাপারটি আমার মাথার মধ্যে কেমন করে জানি ঢুকে যায়। নব্বই-এর দশকে, ১৯৯৪ সালে দৈনিক ভোরের কাগজ প্রকাশের বেশ কিছুদিন পর সেখানকার শিশুদের পাতা ইস্টিকুটুমের সম্পাদক মুন্নী সাহা আমার ধাঁধার আগ্রহকে লেখালেখিতে রূপ দিতে বলেন। তারপর থেকে ধাঁধা-পাজল নিয়ে আমি লিখেই যাচ্ছি।

দাদীর পরে আমাকে ধাঁধাতে আগ্রহী করে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক/মাসিক আনন্দমেলা পত্রিকা। সেখানে প্রতি সংখ্যাতে প্রকাশিত ধাঁধার উত্তর দেওয়া হতো পরের সংখ্যাতে। ফলে, ধাঁধার সমাধান করার জন্য লম্বা সময় পাওয়া যেতো। অনেক চিন্তাভাবনা করা যেতো, কাটাকুটি করা যেতো। আর সেখান থেকে টের পেলাম ধাঁধার জগতের এক বড় অংশই আসলে গণিতের সঙ্গে সম্পর্কিত। গণিতের নানান বিষয়কে আসলে ধাঁধার মতো করে উপস্থাপন করা যায়।

তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় আনন্দমেলায় প্রকাশিত একটি সমস্যা আমার মাথা খারাপ করে দেয়।

তিন

মন্ত্রী গবুচন্দ্রের পরামর্শ নিয়ে রাজা হবুচন্দ্র তার দেশের দ্রব্যমূল্যের দাম ঠিক করে দিলেন কোন এক বেজোড় সালে। নিয়মটা হলো – জোড়া সালে যে কোন পণ্যের মূল্য ২৫ শতাংশ বেড়ে যাবে কিন্তু পরের বছর মানে বেজোড় বছরে দাম কমে যাবে ২০ শতাংশ। ১০ বছর পরে সে দেশে জিনিষ পত্রের দামের কী অবস্থা হবে?

অনেক কাটাকুটি করে আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম। কিন্তু পরের মাসে আনন্দমেলা আসার পর দেখি আমার উত্তর হয়নি। কেন হয়নি সেটি বোঝার জন্য আমাকে কিছু গণিত জানতে হলো!

আমি চট্টগ্রামের যে স্কুলে পড়তাম সেখানকার গণিত-বিজ্ঞান শিক্ষক সাত্তার স্যারও  মাঝে মধ্যে আমাদের মাথা খেলানোর সমস্যা দিতেন। একবার বললেন বাড়িতে গিয়ে নানা ব্যাসার্ধের বৃত্ত আকঁতে। তারপর মা’র কাছ থেকে সুতা নিয়ে বৃত্তের পরিধির মাপ বের করতে এবং পরিধিকে ব্যাসের দৈর্ঘ দিয়ে ভাগ করতে। আমরা সবাই পরদিন সেটা করে নিয়ে আসি। তারপর স্যার আমাদের সবার রেজাল্ট একে একে বোর্ডে লিখতে শুরু করেন। স্যার যখন বোর্ডে লিখছেন তখন আমাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যায় কারণ একজনের সঙ্গে আরেকজনের ভাগফল মিলে যায়। ক্লাসের হৈ চৈ স্বত্ত্বেও স্যার একের পর এক ভাগফল লিখতে থাকেন এবং আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করি স্যার বোর্ড যা লিখছেন সেগুলো প্রায় কাছকাছি- ৩.১৪…. এর কাছাকাছি। আমাদের অবাক করে দিয়ে স্যার জানালেন, বিশ্বের যে কোন স্থানে এরকম আঁকা বৃত্তের পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে সেটি আসলে একটি ধ্রুব সংখ্যা হবে এবং এটিকে বলা হয় পাই (π)! সে থেকে পাই আমার প্রিয় সংখ্যার একটি। আমি যখন কাউকে কোন অটোগ্রাফ দেই তখন মাঝে মধ্যে লিখি “তোমার জীবন π-এর মতো সুন্দর হোক”।
তো সেদিন আমরা শিখলাম যে কোন বৃত্তের পরিধি হলো – πd বা 2πr। যেখানে d হলো ব্যাস আর r হলো ব্যাসার্ধ। তারপর তিনি একটা বাড়ির কাজ দিয়ে দিলেন।

চার

বৃত্তের ক্ষেত্রফল কতো?

সেদিন বাসায় ফিরে শত চেষ্টা করেও আমি সেটা বের করতে পারলাম না। পরদিন স্যার যখন সেটি করিয়ে দিলেন তখন আমি অবাক হয়ে দেখলাম ব্যাপারটা কতো সহজ কিন্তু সুন্দর।
এভাবে আমি ধীরে ধীরে গণিত, ধাঁধা, কালিদাসের ফাঁকি আর শুভঙ্করের ফাঁকি বা আর্যার প্রেমে পড়ে গেলাম। আনন্দ মেলাতেই প্রথম আমি স্যাম লয়েড, হেনরি আর্নেস্ট ড্যুডনি, স্কট মরিস, মার্টিন গার্ডনারের কথা জানতে পারি। কিন্তু তাদের কোন বই কখনো দেখিনি। বুয়েটে পড়তে আসার পর সায়েন্স ল্যাবরেটরির চতুর্থ তলায় ব্যান্সডক লাইব্রেরিতে আমি প্রথম সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকার সঙ্গে পরিচিত হই। সেখানে আমার পরিচয় হয় মার্টিন গার্ডনারের সঙ্গে। ১৯৯৫-৯৬ সালে ভোরের কাগজের ইস্টিকুটুম পাতায় ধারাবাহিকভাবে আমার প্রকাশিত হতে শুরু করে। এটা দেখে জামিল স্যার (জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী) একবার বিদেশ থেকে ফেরার সময় আমাকে ভারতীয় গণিতবিদ (হিউম্যান কম্পিউটার নামে পরিচিত) শকুন্তলা দেবির “পাজলস টু পাজল ইউ” নামে একটি বই এনে দেন। সেটি আমার ধাঁধা নিয়ে কোন সম্পূর্ণ পড়া প্রথম বই।

ধাঁধা নিয়ে আমার আগ্রহ আমাকে টেনে নামায় গণিত অলিম্পিয়াডে। আমি নিজে যেহেতু কম-বেশি গণিত ভালবাসতাম, তাই গণিত কেন ভীতিকর এটা আমার কাছে পরিস্কার হতো না। ধীরে ধীরে আমি কিছুটা হলেও অন্যের জুতা পড়ে দুনিয়ার দিকে তাকাতে শিখলাম। সে সময় গণিত নিয়ে আমাদের যতো গবেষণা তাতে আমাদের শিক্ষার্থীদের গণিত ভীতির অনেকগুলো কারণ আমরা বের করে ফেলেছি। তার মধ্যে একটি হলো শ্রেণীকক্ষের গণিত শিক্ষা মোটেই আনন্দময় নয়।
আমি তখন ফিরে গেলাম আমার দাদীর  কাছে। এবং বুঝতে পারলাম ছোটবেলা থেকে গণিতে একটি শিশুকে আগ্রহী করার যে কয়টা ভাল বুদ্ধি তার একটি হচ্ছে তার মধ্যে একটি ধাঁধা সমাধানের মন তৈরি করা। ধাঁধা তো শেষ পর্যন্ত একটি সমস্যা, কিন্তু সেটিকে আসলে সেরকম ভীতিকর কোন সমস্যা মনে হয় না। কাজে ধাঁধার সমাধান করতে শেখা মানেই প্রবলেম সলভিং-এ হাতে খড়ি।
এই চিন্তা থেকে আমি এর আগে বেশ কিছু বই লিখেও ফেলেছি। সরাসরি ধাঁধার যে তিনটি বই সেগুলোতে ধাঁধাটাই মুখ্য, গণিতটা সাবসিডিয়ারি। আর এই সিরিজটাতে আমি জোর দেবো গণিতে কিন্তু সেটি থাকবে ধাঁধায় মোড়ানো।

সবার জীবন পাই এর মতো সুন্দর হোক।

শুভ সকাল

 

One Reply to “ধাঁধায় মোড়ানো গণিত -১: শুরুর শুরু”

Leave a Reply