ইমোশনাল মার্কেটিং-ভূমিকার পরিবর্তে

Spread the love

আমি নিজে একজন ভূমিকাবাজ লেখক। গণিত অলিম্পিয়াড এবং পরে অন্যান্য কার্যক্রমের ফলে অনেক তরুণ লেখক আমার কাছে তাদের বই-এর ভূমিকা লেখার অনুরোধ নিয়ে আসে। আমি যেহেতু কাউকে না বলতে পারি না, কাজে গণিত, বিজ্ঞান ও প্রোগ্রামিং-এর অনেক বই-এ আমার লেখা ভূমিকা আছে। ঔ লেখকরা সবাই প্রায় নতুন। ফলে, অন্য কেউ তাদের ভূমিকা লেখার রিস্ক নিতে চান না। তো, এরকম একটা লোকের নিজের বই-এ কোন ভূমিকা থাকবে না সেটা কী হতে পারে?
এই বইটা আমি কেন লিখলাম? যদি বলতে পারতাম – এই ধরেন ভাল্লাগে। খুশীতে, ঠ্যালায়। তাহলে খুশি হতাম। কারণ তাহলে আমাকে এতো কষ্ট করতে হতো না। আমি মূলত মনের আনন্দেই লিখি। কিন্তু বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের  উদ্যোক্তা প্ল্যাটফর্ম “চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব”  করতে গিয়ে দেখলাম আমাদের দেশে উদ্যোগ এবং উদ্যোক্তা বিষয়ক বই কম। বাংলা ভাষাতে সেরকম বই নাই বললেই চলে। এমনকী ইংরেজি বইগুলোও সেভাবে পাওয়া যায় না। নানাজনকে উসস্কানি দিয়েছি বই লেখার জন্য। তারপর ভাবলাম থাক নিজেই চেষ্টা করি। প্রথমে গাঁদা গাদা বই পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে দুইটা বই ভাল লেগে গেল। একটা রায়ান হলিডের গ্রোথ হ্যাকার মার্কেটিং। পড়তে গিয়ে টের পেলাম আমার আত্মানুসন্ধানের প্রথম পর্ব, আমার বুয়েট জীবনের ঘাত প্রতিখাতের আখ্যান “পড়ো পড়ো পড়ো”-এর মার্কেটিং কারতে আমি যা যা করেছি সেটিকেই নাকি গ্রোথ হ্যাক করা বলে!!!

তারপর ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে দেখলাম এই কৌশলগুলো চালু হয়েছে হটমেইলের আমল থেকে, সাবির ভাটিয়াদের হাত ধরে। তারপর একটি চোখ-কান খোলা রেখে জানলাম আমাদের দেশে এগুলো ফর্মালি পড়ানো হয় না এবং সবচেয়ে বড় কথা এর কোন বাংলা বই-ও নেই। তো ভাবলাম এটি অনুবাদ করে ফেলা যাক। অনুবাদ করতে গিয়ে দেখলাম, না শুধু বিদেশী উদাহরণে কী লাভ? নিজেদের উদাহরণ দিতে না পারলে তো কেউ এটা বুঝবেও না, প্রাসঙ্গিকতাও পাবে না। কাজে রায়ানের বইকে সামনে রেখে, নিজের অভিজ্ঞতার মিশেল দিয়ে লিখে ফেললাম “গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং”। দেখলাম লোকে বইটি পড়েছে। তারপর কয়েকজনকে পাওয়া গেল যারা জানালো যে, শুধু তারা পড়েনি, তাদের কাজেও লেগেছে। এর মধ্যে ইংলন্ডের ইনোসেন্ট কোম্পানির শরবতের ইতিহাস আর জার্নি পড়ে ফেললাম এবং দেখলাম আরে এতো দেখি আমাদের উদ্যোক্তাদের গল্প। কাজে “শরবতে বাজিমাত”ও হলো।
২০১৮ সালের মাঝামাছি এসে ভাবলাম আমার এই গরীব উদ্যোক্তাদের জন্য আরও বই লেখা দরকার। দুটো বই-এর কথা ভাবলাম। একটি হলো “হাতে কলমে গ্রোথ হ্যাকিং”। মানে ধাপে ধাপে কীভাবে গ্রোথ হ্যাকিং-এর নিয়মকানুন, কলা কৌশল নিয়ে কাজ করবে তার একটা গাইড বই। কাজও শুরু করলাম। কিন্তু অচিরেই টের পেলাম গ্রোথের সঙ্গে ভালবাসা আর আবেগের একটা বড় সম্পর্ক আছে। আর মার্কেটারদের আবেগ ব্যবহারের হারও বেড়ে গেছে নানাবিধও কারণে। প্রথম কারণটা অবশ্যই ইন্টারনেট আর স্যোসাল মিডিয়া। ইচ্ছে করলেই যে কোন প্রতিষ্ঠান এখন কোন টাকা খরচ না করেই একটি ভিডিও কমার্শিয়াল ইউটিউবে ছেড়ে দিতে পারে। তারপর সেটির ক্যাম্পেইন করতে পারে স্যোসাল মিডিয়াতে। এমনকী বড় বড় ব্যান্ডগুলোও এই মাধ্যম ব্যবহার করতে শুরু করেছে যদিও তাদের টিভিতে যাওয়ার টাকা আছে। অন্যদিকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যে কেউ ভিডিও বানিয়ে ফেলতে পারে। কাজে কাজটা হয়ে গেল সহজ।
মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুকসহ স্যোসাল মিডিয়াগুলো মার্কেটারদের সামনে এক নয়া দুনিয়ার সন্ধান এনে দিয়েছে। এখন আপনি ইচ্ছে করলেই আপনার অডিয়েন্সের সঙ্গে রিয়েল টাইমে “কথা” বলতে পারেন, অবসরে তাদের মন্তব্যের জবাব দিতে পারেন এবং হয়ে উঠতে পারেন তাদের নানা আয়োজন, বিপদ-আপদের পরিত্রাতাও। আমি বাংলাদেশের একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে চিনি যারা তাদের গ্রাহকের কাছে নিজেদের একটি বিশেষ চরিত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। সেটি হলো তারা খুবই আন্তরিক। আমি দেখেছি অনেক খদ্দের তাদের ফোন করে বলেন, “আমি জানি আপনারা “অমুক” জিনিষটা বিক্রি করেন না। কিন্তু আমাকে যদি এনে দেন তাহরে খুশি হই”। ঐ প্রতিষ্ঠান তখন তার ইনভেন্টরির বাইরে গিয়ে “অমুক” জিনিষটা কিনে আনে ও সরবরাহ করে! এ কদিন আগেও কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার খদ্দেরের এমন সম্পর্ক তৈরি হওয়াটা বলতে গেলে সম্ভবই ছিল না। কিন্তু এখন এরকম একটি “ব্যক্তিগত” সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে।
অন্যদিকে, এখন প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই তাদের পণ্য-সেবার প্রসারের জন্য সব রকমের চ্যানেল ব্যবহার করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং কিন্তু সেলসম্যান-মার্কেটারদের জন্য নতুন নতুন সব ধারণার জন্ম দিচ্ছে প্রতিদিন আর সেসব নিয়ে লাখো লাখো মার্কেটার ঝাপিয়ে পড়ছে সব চ্যানেলে। ফলে, আগের তুলনায় এখন আপনার “মুখ ঢেকে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনে”। এতসব চ্যানেল, এতো সহজে বিজ্ঞাপনের কারণে মার্কেটারদের কাজ কিন্তু কঠিন হয়ে যাচ্ছে!!!
মার্কেটারদের, উদ্যোক্তাদের তাহলে বের হয়ে আসার, অনেকে ভিড়ে আলাদা থাকার উপায় কী?
উপায় হলো নিজেকে আলাদা করতে শেখা। কেমন করে?

পড়ে, পড়ে, পড়ে। দেখে, দেখে, দেখে এবং শুনে শুনে শুনে।

নতুন মার্কেটিং কৌশল শেখা এবং প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিশীলিত করার কোন বিকল্প নেই। এ নিয়ে লড়াই সংগ্রাম করতে হবে। আর সেই সংগ্রামেরই আর একটা নাম হলো ইমোশনাল মার্কেটিং
আমি যখন ইমোশনাল মার্কেটিং নিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজের বই আর পর্দায় নানা ব্লগ-আর্টিকেল পড়তে শুরু করি তার আগ পর্যন্ত আমার কাছে ইমোশনাল মার্কেটিং-এর উদাহরণ ছিল কেবল হালাল সাবান আর হিজাব রিফ্রেশ স্যাম্পু। কিন্তু, যতো গভীরে গেলাম ততোই টের পেলাম ব্যাপারটা কেবল ধর্মীয় আবেগ নয়। এমনকী কেবল সেটি নয় মায়ের প্রতি ভালবাসা। জানলাম আবেগের একটা বিশাল সায়েন্সও আছে। রঙ দিয়ে আবেগকে নিয়ন্ত্রণও করা যায় এবং আবেগ দিয়েই উস্কে দেওয়া যায় মার্কেটিংকে। এবং সেটি ব্যাপকভাবে।
তখন আমি এই বইটা পরিকল্পনা করি। এই বই পরিকল্পনায় আমার প্রকাশক মাহবুবুর রহমান ও তার কর্মী সরফরাজ (আসলে সরাফত, কিন্তু আমি কেন জানি তাকে সরফরাজই ডাকি)-এর একটা ভূমিকা আছে। তারা বলতে গেলে আমাকে চাপের মধ্যেও রেখেছে যেন আমি এই বইটা লিখি।
তো, আমি যখন বইটা লিখবো ঠিক করি তখন আমার অলস মন এই বলে সায় দিয়েছে “ওতো চিন্তার কী আছে। তোমার ওস্তাদ টিম ফ্যারিস বা রায়ান হলিডে নিশ্চয়ই এই বই লিখে ফেলেছে। সেটাকে সামনে রেখে লিখে ফেললেই হলো। শুধু হালাল সাবান বা হিজাব ওয়ালীদের কথা মনে রাখলেই হবে”।
আহা। কাজটা যদি এতো সহজ হতো। কিন্তু “বিধি হলে বাম, কী করবে রাম”। আমার ওস্তাদরা কেউ এমন কোন বই এখনো লিখেন নাই যেটা সামনে রেখে টুকলিফাই করে, নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এই বইটা আমি লিখতে পারি।
ফল যা হওয়ার তাই হলো। আমাকে পড়তে শুরু করতে হলো পাঠ্যবই, পড়তে হলো হাজার ব্লগ। এমনকী নজর রাখতে হলো বিশেষ বিশেষ টুইটে। এতে যে সময়ের মধ্যে এটা লেখা যাবে মনে করেছি, সেটি কিন্তু আর হলো না।

তারপরও ২০১৯এর বই মেলা ধরা হয়তো যেতো কিন্তু সেটা গেল না দুই কারণে। শোনা গেল, আমার প্রকাশককে নাকি এবার স্টলই দেওয়া হবে না। এ নিয়ে ম্যালা দেনদরবার করতে হলো। আর সবচেয়ে খারাপ হলো ভাইরাস ব্যাটারা এটাক করে আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেল। প্রায় একমাস আমি তেমন কিছুই করতে পারলাম না। ফলে আরও পেছালো।
এই বইটা মূলত উদ্যোক্তা ও মার্কেটারদের জন্য। নিজেদের পণ্য ও সেবার খবর পৌছে দেওয়া, সম্ভাব্য খদ্দেরকে আকৃষ্ট করা কিংবা বিদ্যমান খদ্দেরকে ধরে রাখার জন্য ইমোশনাল মার্কেটিং বই-এর কৌশল, পদ্ধতির প্রযোগ ঘটানো যাবে। আমার নিজের ব্র্যান্ড এওয়ারনেস বাড়ানোর জন্যও এই কোশলগুলো কাজে লাগবে।

এই বইটি এক নাগাড়ে পড়ে গেলে মুশ্কিল। এটি পড়তে হবে দুই ধাপে। প্রথমবার এক নাগাড়ে, গল্পের মতো করে। দ্বিতীয়বার থেমে থেমে। উদাহরণগুলো দেখার জন্য কখনো কিআর কোড স্ক্যান করতে হবে বা ব্রাউজারে সেটা টাইপ করতে হবে। কখনো চোখ বুঝে মনে করতে হবে উদাহরণের বিজ্ঞাপনগুলোকে। সবশেষে ভাবতে হবে নিজে কেমন করে এই কোশল কাজে লাগাতে পারবেন।

তবে, এই বই কাদের সবচেয়ে বেশি কাজে লাগবে সেটা বলার আগে আমার বোনের গল্প বলি। আমি যখন বুয়েটে পড়ি তখন ছিল ভিসিআরের যুগ। আমার একটা মেম্বারশীপ ছিল ফিল্মফেয়ারে। সেখান থেকে ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে ছুটির দিনে বোনের বাড়িতে যেতাম। একবার আপা আমাকে বললেন – জেন ফন্ডার একটা যোগব্যায়ামের ক্যাসেট বের হয়েছে। তুই মাসখানেকের জন্য ক্যাসেটটা নিয়ে আসিস তো। তো, আমি সেটা যথারীতি আমার বোনের বাসায় দিয়ে আসলাম। পরে একদিন কথা প্রসঙ্গে দুলাভাই-র কাছে জানতে চাইলাম আপা কী ক্যাসেট দেখে ব্যায়াম করে?
দুলাভাই বললেন- হ্যা। তোমার আপা ক্যাসেটটা চালিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেটা দেখে।

সকল উদ্যোক্তা ও পাঠকের সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।

One Reply to “ইমোশনাল মার্কেটিং-ভূমিকার পরিবর্তে”

  1. আমি “গ্রোথ হ্যাকার মার্কেটিং” এবং আপনার ব্লোগ গুলো পড়েছি, খুব ভালো, ভালো বলতে আমি 2014 থেকে 2017 সাল Rangpurmarket.com ও 2017 থেকে 2020 মোর্চ পর্যন্ত A to Z Haat (atozhaat.com/atozhaat.com.bd) এর কাজ করতে গিয়ে আমাদে আপনার বইগুলো অনেক উপকার করছে।ই-শপ গুলো আমার। এখন পর্যন্ত গবেষনা করে যাচ্ছি দাড়াতে পারি নাই………………. এখন পারবো………

Leave a Reply