এমবুশ মার্কেটিং -১ : ঢিলটি মারিলে পাটকেলটি খেতে হয়

Spread the love

২০১৭ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে পৌঁছার পর আমার ইচ্ছে হলো দুইটি। আলকেমির লেখক পয়েলো কোহেলোর বাড়িতে যাওয়া। আর একটি হলো অলিম্পিক স্টেডিয়াম দেখা যেখানে উসাইন বোল্ট দৌড়েছেন। কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাবার পথেই জেনে গেলাম পয়েলো কোহেলো রিও কেন ব্রাজিলেই থাকেন না। তার বাড়িটা আছে। সেটির সামনে দিয়ে যেতে পারবো। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা করা বা ইন্টারভিউ করা হবে না। আর ২০১৬ সালের অলিম্পিক পল্লী আর স্টেডিয়াম সবই বিরান ভূমি। তাও একদিন স্টেডিয়ামের সামনে যাওয়ার সুযোগ হলো। চট করে আমি চলে গেলাম এক বছর আগের এক দিনে।

অলিম্পিকে এথলেটিক্সের অন্যতম সম্মানজনক ইভেন্ট হলো ১০০ মিটার দৌড়। এর বিজয়ীকে বলা হয় বিশ্বের দ্রুততম মানব/মানবী। গ্রিফিথ জয়নার জো’র পর মহিলাদের দৌড় দিয়ে তেমন আগ্রহ আমার ছিল না। কিন্তু সেবারের অলিম্পিকের শুরু থেকে দেখার ইচ্ছে ছিল উসাইন বোল্ট তৃতীয় বারের মতো ১০০ মিটার জিততে পারেন কিনা। উসাইন বোল্টকে আমি ফলো করতাম এজন্য নয় যে তিনি তখনই বিশ্বের দ্রুততম মানব। তাকে ফলো করার কারণ দ্রুততম মানব হওয়া স্বত্ত্বেও তার একজন কোচ আছে যিনি তার থেকে দ্রুত দৌড়াতে পারেন না! আর রাতারাতি সাফল্যের জন্য যে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয় সেটারও তিনি সাক্ষাৎ প্রমাণ। ওপরের ছবিটা তার বিখ্যাত ভঙ্গিমার। গণিত অলিম্পিয়াডে আমরা শিক্ষার্থীদের দিয়ে এই ভঙ্গিমার ছবিও তুলেছি।

শত মিটারের দৌড়

কাজে রিও অলিম্পিকে ১০০ মিটার দৌড়ের দিন সারা বিশ্বের লোকের সঙ্গে আমিও ঢাকা শহরে টিভির সামনে বসা। সকাল সাতটার দিকে মনে হয়। বোল্ট দৌড়াবেন ৬ নম্বর লেনে। আর তার কঠিন প্রতিদ্ধন্ধী জাস্টিন গ্যাটলিন দৌড়াবেন ৪ নং লেনে। নিজের মনে একটি কনফিউশন আছে।

এর আগে অলিম্পিকে পরপর তিনবার ১০০ মিটার কি কেউ জিতেছেন? না। কার্ল লুইস পরপর দুইবার জিতেছেন। আরও কয়েকজন দুইবার জিতেছেন। কিন্তু তিনবার কেউ নন! কাজে বিশ্ববাসী আমার মতো বুকে ধুকপুকানি নিয়ে হয় স্টেডিয়ামে না হয় টিভির সামনে বসা।

দৌড় শুরু হতেই দেখা গেল গ্যাটলিনের শুরুটা ভাল। আমি একটু হতাশ হয়ে গেলাম। কিন্তু শেষ ৩০ মিটারে লম্বা ঠ্যাং নিয়ে বোল্ট ঠিকই বের হয়ে গেলেন এবং ৯.৮১ সেকেন্ডে নতুন অলিম্পিক রেকর্ড করে যথারীতি নতুন ইতিহাস গড়ে ফেললেন। তারপর দীর্ঘক্ষণ ধরে তিনি মাঠ জুড়ে ঘুরে বেড়ালেন। গায়ে জ্যামাইকার পতাকা জড়ালেন। এক সময় পা থেকে তার সোনালী বুট খুলে সামনে রাখলেন। বুট জোড়া হাতে নিয়ে তার সেই বিখ্যাত স্টাইলে ছবিটা তুললেন।

জুতা হাতে নিয়ে স্টেডিয়াম এক চক্কর দিয়েও দিলেন।

সবই ঠিক আছে। কিন্তু জুতা কেন হাতে?

মেরা জুতা হ্যা সোনালি

এই প্রশ্নের জবাব পেতে আমাকে ছুটতে হলো জার্মানির হারজোনোইরচ শহরে, পুমার হেডকোয়ার্টারে। ওখনে তখন বাজে ভোর রাত ৩.৩১ মিনিট। ভোররাত, কিন্তু অফিসে মেলা লোকজন। সবাই টিভিতে দৌড় দেখেছে যেন বোল্ট নয় দৌড়েছে পুমা।

আরে তাইতো। এই গোল্ড মেডাল উসাইন বোল্ট কেবল জ্যামাইকার জন্য জিতেননি। পুমার জন্যও জিতেছেন। কিন্তু তিনি যে জিতবেন সেটা তো প্রায় সবাই জানতো। তাহলে এরা অফিসে এসেছে কেন?

উসাইন বোল্ট পুমার অ্যাম্বাসেডর। পুমা প্রতিবছর তখন প্রায় ১০ মিলিয়ন ইউরো করে দেয়! ঠিক আছে কিন্তু ওরা কেন জেগে?

সামাজিক মাধ্যমে তৎপরতা

বোল্ট যখন স্টেডিয়ামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখন পুমার স্যোসাল মিডিয়া টিমের কাজ শুরু হলো। একটু পরেই পুমার অফিসিয়াল টুইটার ও ইনস্টাগ্রাম একাউন্টে ভেসে উঠেছে- “When you are @Usain Bolt, you are #ForeverFastest”।

কিন্তু ওদের শ্লোগানতো “Forever Faster”। কিন্তু ভালমতো দেখে বোঝা গেল আরে পোস্টের কোথাও তো রিও অলিম্পিক নেই। অলিম্পিকের  #Rio2016 বা #Olympic হ্যাশট্যাগও নেই। এমনকী ছবিতে বোল্টও নেই। এতোক্ষণে আপনি দৌড় দেখে নিয়েছেন। খেয়াল করলে দেখবেন এই্ জুতার সঙ্গে বোল্টের জুতার সামান্য অমিল আছে। তাদের ফেসবুকের পোস্টে দেখা গেল উসাইন বোল্টের গোল্ডেন শ্যু – “WHO FASTER? Usain Bolt and #ForeverFastest”.

এখন বুঝতে পারলাম। কারণ পুমা রিও অলিম্পিকের স্পন্সর নয়। জুতার স্পন্সর হলো নাইকি! আর আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি স্পন্সরশীপের ব্যাপারে ব্যাপক কঠিন। স্পন্সরদের স্বার্থ রক্ষা করাটাই তাদের কাজ। ১৯৮৮ সালে তারা আমেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ডকে হুমকি দিয়েছিল যে, লাইনে না আসলে অলিম্পিকের সব তারকারা একত্র হয়ে এক্সপ্রেসের ক্রেডিট কার্ড কাঁচি দিয়ে কাটবে।

এজন্য পুমা অলিম্পিকের ধারে কাছে নাই। ঐদিন রাতে তাদের একটিভিটি দেখে মনে হতে পার এটা হয়তো আগের দিন পুমা ঠিক করেছে। কিন্তু আসলে তা নয়।

আগে থেকেই এমবুশের পরিকল্পনা

বোল্ট যখন জুতা নিয়ে মাঠে দৌড়াচ্ছেন তখন তিনি এমনভাবে জুতাটা হাতে রেখেছেন যে সবারই চোখ সেখানে যাবে। জুতাতে সামান্য পরিবর্তনও করা হয়েছে। ছবি দুইটি দেখুন।

ইউরোপে অলিম্পিকের সামান্য আগে থেকে এই জুতাটা পুমা বাজারবাত করে রেখেছে “নিউ এরাইভাল” নামে। এক জোড়ার দাম “Usain Bolt Evospeed Electric Spike Shoes” – মাত্র ১৩০ ইউরো (কমবেশি ১৩ হাজার টাকা)।

পুমা ও বোল্ট আগে থেকেই ঠিক করেছে বোল্ট কীভাবে জুতাটা তুলে ধরবেন। তার জুতার মধ্যে ঐ লেখাটাও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কারণ কে না জানে সব টেলিভিশন, মিডিয়া বোল্টকে জুম করবে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। বোল্টের দৌড়ানোর সময় কিন্তু পুমার ঐ শ্লোগান ছিল না। দৌড় শেষ হওয়ার পরই নতুন এই শ্লোগানটি তারা নেয়।

তবে পুমার পোস্টের কোথাও অলিম্পিক বা গোল্ড মেডালের কথা উল্লেক করেনি। কারণ সেটা দরকার ছিল না। কারণ বিশ্বের তাবৎ লোক যারা অলিম্পিককে ফলো করে তারা তো বটেই ১০০ মিটার কে জিতেছে সেটা সবাই জানে। কাজে ঐ বাহুল্য তাদের লাগেনি। অলিম্পিকের উল্লেখ ছাড়াই তাদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে।

এভাবে আইওসির নিয়ম-কানুনকে সাফল্যের সঙ্গে কলা দেখিয়ে অলিম্পিকের সুফল পুমা নিজেদের ঘরে তুলে নিতে পেরেছে। পরবর্তী কয়েকমাসে এই জুতার বিক্রি হিসেবের চেয়ে মাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলার বেশি হয়েছে

ঐ অলিম্পিকে ২০০ মিটারও উসাইন বোল্ট জিতেছেন। কিন্তু সেদিন তিনি জুতা নিয়ে তেমন কিছু করেননি। এমনকী পুমার ঐ জুতাও পড়েননি। কারণ সেটার আর দরকার ছিল না।

যারা পুমার এই সাফল্যে উচ্ছসিত এবং একই সঙ্গে নাইকির হতাশা নিয়ে একটু চিন্তিত তারা এবার আবার আমার লেখার শিরোনামটা দেখতে পারেন। ঢিল আর পাটকেল এখানে কোথা থেকে এলো?

সে অন্য গল্প, অন্য কাহিনী। পরের পর্বে  দেখা যাক সেটি বলা যায় কিনা।

 

[আমার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন টুইটার, লিংকডইন, ইউটিউব বা ফেসবুকে]

 

One Reply to “এমবুশ মার্কেটিং -১ : ঢিলটি মারিলে পাটকেলটি খেতে হয়”

Leave a Reply