মালা শাড়ির আনোয়ার হোসেন

Spread the love

আজ ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট চলে গেলেন মালা শাড়ির আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার গ্রুপের উদ্যোক্তা তার মেয়ের নামে ‘মালা’ শাড়ি তৈরি করতেন টঙ্গীর আনোয়ার মিল থেকে। নানা কিছু করলেও লোকে তাকে মালা শাড়ির আনোয়ার হোসেন হিসেবেই চিনতেন। যদিও তাঁর তৈরি গ্রুপের রয়েছে ২৬টি প্রতিষ্ঠান যার ২০টিই কোম্পানি। প্রায় ১২ হাজার কর্মী সেখানে কাজ করেন। এগুলো বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, আবাসন, পলিমার, আসবাব, অটোমোবাইল, ব্যাংক, আর্থিক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত।

স্বাধীনতার আগে ও পরে আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় তিনটি ব্র্যান্ডের নাম করতে হলে মালা শাড়ির কথা বলতেই হবে। আশির দশক পর্যন্ত মালা শাড়ি ছাড়া বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠান অপূর্ণাঙ্গ থাকতো। আশির দশকে বিটিভিতে আমরা এমন বিজ্ঞাপন দেখতাম যার জিঙ্গেলের একটা লাইন ছিল – মালা শাড়ি না দিলে বিয়ে বমু না

যাদের হাত ধরে বাঙ্গালির ব্যবসার পূঁজি গঠন হয়েছে, বেসরকারি খাত বিকশিত হয়েছে তাদের অন্যতম আনোয়ার গ্রুপের উদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন।

আনোয়ার হোসেনের যখন মাত্র সাত বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। ব্যবসা শেখার জন্য কয়েক বছর পর তার বড় ভাই তাকে পাশে ভোলা মিঞা নামের একজনের দোকানে কাজ পাইয়ে দেন। ভাতা মাসে ১৫ টাকা। আর দৈনিক ২ আনা নাশতার খরচ।

তার মিঞাভাই মোহাম্মদ হোসেন আনসার বাহিনীতে যোগ দিলে আনোয়ার হোসেন বাবার ব্যবসা দেখতে শুরু করেন। কিন্তু মিঞাভাই ফিরে আসলে নিজে কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। ভোলা মিঞার দোকানে কাজ করে জমানো ৯০ টাকা। মা’র কাছে থেকে ‘চান্দির টাকা’ মানে রূপার মুদ্রা পেলেন ২০০টি। বিক্রি করলেন ৩৯০ টাকায়।

“৪ বছরের ব্যবসা- অভিজ্ঞতা পূজি করে, ১৫ বছর বয়সে, ১৯৫৩ সালে , চকবাজারে নিজের কাপড়ের ব্যবসা শুরু করলাম। বাবার ২০৭ নম্বর দোকান ছেড়ে দিয়ে নিজের জন্য আলাদা একটা দোকান নিলাম। সাড়ে পাঁচ হাত-সাড়ে তিন হাতের দোকানটার নম্বর ছিল ২২০, আর নাম “আনোয়ার ক্লথ স্টোর”।

প্রথম দিকে শুধু শাড়ি আর লুঙ্গির ব্যবসা করতেন। দোকান থেকে রায়েরবাজারের হাটে গিয়েও কাপড় বিক্রি করতেন। “লু্ঙ্গির ১ মন ওজনের গাঁটরি বহন করতাম নিজ কাঁধে। পরনের লুঙ্গির ভাঁজের মধ্যে রাখতাম মুড়ি আর পিয়াজু, আমলীগোলা থেকে রায়ের বাজার পর্যন্ত ২ কিলোমিটারের রাস্তার পুরোটা হাঁটতাম আর একহাতে পাঁটরি সামলাোর ফাঁকে ফাঁকে আরেক হাতে সদ্ব্যবহার করতাম সেসব খাবারের”।

ব্যবসা বাড়তে থাকে। বড় বোনের শাশুড়ির কাছ থেকে ২০০ টাকা ধার নেন। সেই টাকা পুরোটাই অগ্রিম হিসাবে দিয়ে দেন তার সাপ্লায়ারকে। এতে দুটো লাভ হলো। প্রথমত সাপ্লায়ার, চকবাজারের হোসেন ব্রাদার্স তাকে আরও বেশি ছাড় দিল। আর ক্রেডিটের পরিমাণও বাড়িয়ে দিল। কাজে আগে যেখানে কয়েকবার হোসেন ব্রাদ্রাসের যাওয়া লাগতো মাল আনতে সেটা কমে গেল। আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারলেন ব্যবসাতে। একসময় চকবাজারে পাশের ছয়টি দোকান কিনে নিলেন। আর মাত্র ২০-২৫ দিনের মধ্যে ধারের টাকা ফেরৎ দিয়ে দিলেন।

১৯৫৬ সালে বাড়িতে শাড়ির ছাপাখানা চালু করেন। এই শাড়ির নাম ছিল ফেমাস শাড়ি। কিনে আনা শাড়িতে শুধু ছাপার কাজ হতো। তারপর ভ্যালু এডিশন হিসেবে যুক্ত করলেন ঝালরের কাজ। এই কাজটি তার স্ত্রী আমেনা বেগমকে করতে দেখেন। তারপর মহল্লার কিছু মহিলাকে শিখিয়ে নিলেন। এভাবে কাজ করতে গিয়ে ভাবলেন শিল্প গড়বেন।

এক সময় ইপসিক (এখন বিসিক)-এর চেয়ারম্যান লতিফউল্লাহ-র কাজ থেকে জানতে পারেন এক ভদ্রলোক সিল্ক মিলের কারখানর জন্য মেশিনারি আনলেও সেটা নেননি। ইপসিকে পরে আছে। সেগুলো কিনে, ১৯৬৮ সালে টঙ্গী শিল্প এলাকায় শুরু করলেন ‘আনোয়ার সিল্ক মিলস”। ফেমাস শাড়ির নাম বদলে মেয়ের নামে রাখলেন। শুরু হলো আমাদের প্রথম শাড়ির ব্র্যান্ড ‘মালা শাড়ি’র কার্যক্রম।

সেই শুরু। আজ চলে যাওয়ার দিনে তিনি রেখে গেলেন ২৬টি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের আর তার অভিজ্ঞতা যা তার উত্তরাধিকাররা বহন করবে।

তাঁর কাছ থেকে শেখা

শিল্পপতি আনোয়ার হোসেনের জীবন থেকে উদ্যোক্তাদের শেখার অনেক কিছু আছে। এর কয়েকটি –

১. সঞ্চয় – নিজে কিছু করতে হলে পূজি, কম হোক, বেশি হোক, লাগবেই। শুরু থেকে নিজে কিছু সঞ্চয় করতে পারলে আপনার কনফিডেন্স বাড়বে। যখন কাউকে বলবেন আপনার অলরেডি এতো টাকা আছে, আর কিছু হলে শুরু করতে পারবেন তখন লোকে আপনাকে টাকা দিবে।

২. নিজের প্যাশন তৈরি করুন – আনোয়ার হোসেন শুরুতে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। কারণ সেটি ছিল তার প্যাশন। এবং সেটাই তিনি ভালভাবে শিখেছেন। ব্যবসার গভীরে যাওয়ার জন্য নিজে আরও চেষ্টা করুন। আনোয়ার হোসেনের নিজের কাঁধে করে কাপড়ির গাঁটরি নেওয়ার কথা ভাবুন। ওনার কিন্তু তখন দোকানের কর্মী ছিল।

৩. ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ঋণ করুন বা বিনিয়োগ নিন – শুধু লাভের টাকা থেকে ব্যবসাকে বড় করা যায না। আপনার দরকার হবে বাড়তি টাকা। এই টাকা দিয়ে আপনি ব্যবসা বাড়াতে পারবেন। খেয়াল রাখতে হবে দুটো বিষয়। বাড়তি টাকা কীভাবে কাজে লাগাবেন ব্যবসা প্রসারের জন্য। দুই কবে নাগাদ ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। সামর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

৪. সুযোগের সদ্ব্যবহার – সুযোগ গ্রহণ করার মতো সাহসী হোন। মনে রাখবেন ফরচুন ফেভার দ্যা ব্রেভ।

[আমার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন টুইটার, লিংকডইন, ইউটিউব বা ফেসবুকে।

দৈনিক প্রথম আলো’তে প্রকাশিত আমার লেখা পড়তে পারেন এখান]

 

 

Leave a Reply