আড়াই হাজার কোটি রুপীর ডিজাইনার

Spread the love

আপনার যদি কখনো সুযোগ হয় ভারতের বিবাহ-যোগ্যা নারীর, হোক সে সাধারণ বা মুম্বাই-এর কোন নায়িকা, কাছে জানতে চাওয়ার তাহলে আপনি জানতে চাইতে পারেন – বিয়েতে কার ডিজাইন করা জামা কাপড় পড়তে চান?
আপনি অবাক হয়ে জানবেন সবাই একজন পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী ডিজাইনারের নাম বলবেন। সব্যসাচী মুখার্জী।
বাংলাদেশের অনেক লোকই তার নাম জানেন তারকাদের বিয়ের পোষাক ও বলিউডের সিনেমার জন্য পোষাক ডিজাইনের জন্য। ২০০৫ সালে সব্যসাচী বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে প্রথম বারের মতো যুক্ত হোন সঞ্জয় লীলা বানসালীর  ব্ল্যাক সিনেমাতে। এবং জিতে নেন সেরা পোশাক ডিজাইনের জাতীয় পুরস্কার। তার ডিজাইনের পোষাক দেখা গেছে গুজারিশ, ইংলিশ ভিংলিশ ইত্যাদি সিনেমায়।

যারা ভাবছেন সব্যসাচী কেবল ভারত জয় করেছেন তাদের জন্য সামান্য তথ্য হলো ২০১২ সালে অপরাহ্ উইনফ্রে যখন ভারত সফর করেন তখন তিনি মুম্বাইতে একটিমাত্র ফ্যাশন হাউজে ঢু  মেরেছেন। আর সেটি হচ্ছে সব্যসাচী। মাত্র কদিন আগে ১১ আগস্ট বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড এইচএন্ডএমের (H&M) সঙ্গে  সব্যসাচী নতুন ডিজাইনের পোষাক উন্মুক্ত করেছেন। পোষাকগুলো উন্মুক্ত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সকল পোষাকই বিক্রি হয়ে গেছে! আর এই পোষাকের মধ্যে ছিল শাড়ি, লেহেঙ্গা, পাঞ্জাবীসহ বাঙ্গালিয়ানার পোষাক। অনেকেই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর পোশাক কিনতে না পেরে হতাশ হয়েছেন এবং এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সব্যসাচীকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু এইচএন্ডএমের সঙ্গে সব্যসাচীর ডিজাইনের এই জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে বাঙালি পোশাকের প্রতি বিশ্ববাসীর আকর্ষণ মোটেই কম নয়।

আর ১০টা সাধারণ গল্পের মতোই সব্যসাচীর গল্প। সংস্কৃতিবান পরিবারের সন্তান হিসেবে ছোটবেলা থেকে হ্যান্ডিক্রাফটস থেকে শুরু করে বাঙ্গালি ঐতিহ্যের প্রতি সব্যসাচীর আকর্ষণ ছিল। কিন্তু গড়-পড়তা বাঙ্গালি বাবা-মার মতো সব্যসাচীর প্রকৌশলী বাবা ও শিক্ষক মা’র ইচ্ছে ছিল সব্যসাচীকে প্রকৌশলী বানানো।  এর মধ্যে ১৫ বছর বয়সে বাবার চাকরি চলে যায় আর সব্যসাচী ঘোষণা করে ডিজাইনার হবে। ভারতের প্রকৌশল বিদ্যার সূতিকাগার আইআইটি নয়, সে পড়তে চায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজিতে (NIFT)। কাজে বাবার সহজ ঘোষণা – এনআইএফটিতে তোমার পড়ার খরচ কিন্তু আমরা দিচ্ছি না।

এনআইএফটিতে ভর্তি পরীক্ষার খরচ জোগাড় করার জন্য সব্যসাচী বাড়ি থেকে পালিয়ে গোয়া চলে যায়। সেখানে একটি রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ করে ভর্তি পরীক্ষার খরচ যোগাড় করে। ভর্তি হলেও পড়ার খরচ কই পাবে? কাজে তিল তিল করে গড়া বই-এর সংগ্রহ বিক্রি করে হাজির হয় নিজের তীর্থে।

১৯৯৯ সালে সব্যসাচী এনআইএফটি থেকে বের হোন। কিন্তু সতীর্থদের মতো কোন ফ্যাশন হাউজে যুক্ত না হয়ে নিজেই একটা কিছু করার চিন্তা করেন। বোনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা হাওলাত করে তিনি তার নিজের নামে (সব্যসাচী) একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড এর সূচনা করেন। পরের পাঁচ বছর নিজের কারখানাতেই তার সময় কাটতো বেশি। কাজই হয়ে উঠে তার জীবন। বাঙ্গালি ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নিজের একটা আলাদা স্টাইল তৈরি করেন। ২০০২ সালে ইন্ডিয়ান ফ্যাশন উইকে আত্মপ্রকাশ করেন।

পরের বছর প্রথম আন্তর্জাতিক কোন ফ্যাশন শো’তে যোগ দেন সিঙ্গাপুরে এবং সেখানে পুরস্কৃত হোন। ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের নতুন মাত্রা যুক্ত হয় যখন তিনি আমন্ত্রণ পান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির চ্যারিটি ফান্ড রাইজিং ফ্যাশন শো’তে। তখনই তিনি বৈশ্বিক ফ্যাশন পিয়াসীদের নজরে পড়তে শুরু করেন। সব্যসাচী এখন পর্যন্ত ভারতের একমাত্র ডিজাইনার যিনি ইতালীর মিলান ফ্যাশন সপ্তাহে নিজের ডিজাইন তুলে ধরতে পেরেছেন।

আনুশকা শর্মা ও বিরাট কোহলিসহ অনেক তারকার বিয়ের পোষাক ডিজাইন করেছেন তিনি। এদের মধ্যে আছেন দীপিকা পাড়ুকোণ, বিপাশা বসু, সামান্থা, বিদ্যা বালান ও ইশা আম্বানি। আর তার কাস্টোমারদের মধ্যে আছেন আলিয়া ভাট, রানী মুখার্জি, শ্রীদেবী, শাবানা আজমি, ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন, দীপিকা পাড়ুকোন, শ্রদ্ধা কাপুর, সুস্মিতা সেন, কারিনা কাপুর খান প্রমূখ।

সব্যসাচী মুর্শিদাবাদের শাড়ির কারিগরদের বিকাশের জন্য কাজ করেছেন। ‘শাড়ি বাঁচাও’ নামে তার একটি আন্দোলনও আছে। সেটিতে ৩ হাজার ৫০০ রুপীর শাড়ি বিক্রি করে বিক্রি লব্ধ অর্থ তুলে দেন মুশির্দাবাদের তাতীদের। তার এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন ঐশ্বরিয়া রাই ও বিদ্যা বালান।

সব্যসাচীর ডিজাইনের লেহেঙ্গাগুলোর গড় দাম ৪ লাখ রূপি। দীপিকা পাড়ুকোনের বিয়ের লেহেঙ্গাটির দাম ছিল ১২ লক্ষ রুপী। তার শো’রুমে হরে দরে ৮-১০ লাখ টাকা দামের লেহেঙ্গা পাওয়া যায়। মুম্বাই মিরর পত্রিকার ধারণা প্রতিদিন গড়ে কেবল ২০টি লেহেঙ্গা বিক্রি হয় তার শো’রুম থেকে। ভারতের কোলকাতা, নয়া দিল্লী, হায়দারাবাদ ও মুম্বাই-এর তার শো’রুম। এছাড়া অনলাইনেও তার পোষাক কেনা যায়।

২০১৪ সালেই সব্যসাচী প্রথম ভারতীয় ডিজাইনার হিসেবে বার্ষিক ১০০ কোটি রুপীর ব্যবসা করতে সমর্থ হোন। ২০১৯ সালে তার প্রতিস্ঠানের বিক্রি ২৫৩ কোটি রুপীতে পৌঁচেছে। সেই হিসেবে তার প্রতিষ্ঠানের ভ্যালুয়েশন প্রায় দুই হাজার ৪০০ কোটি রুপী।

সব্যসাচীর ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি ভারতীয় রুপী ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। প্রতিষ্ঠানের ৯৭ শতাংশের মালিক তিন। বাকী তিন শতাংশের মালিক তার বাবা।

যতো কিছু শেখা

১. নিজের প্যাশনের পেছনে লেগে থাকা – সব্যসাচী তার প্যাশনের জায়গা থেকে সরেন নাই। এবং এটাও ভাবেন নাই যে বাবা-মা’র কথা মতো ‘আগে ইঞ্জিনিয়ার’ হয়ে পরে ফ্যাশনে যাবেন। ওয়েটারের কাজ করে ভর্তি পরীক্ষার খরচ যোগাড় করেছেন এবং পড়ার প্রাথমিক খরচের জন্য নিজের জমানো সব বই বিক্রি করে দিয়েছেন।

২. চাকরি বা  সিনিয়র কারও অদীনে কাজ করেন নি – শুরু থেকে নিজের একটা কিছু করতে চেয়েছেন। সেজন্য চাকরি করতে চাননি। আরও একটা কারণে কারও সঙ্গে যুক্ত হোননি। সেটা হলো সিনিয়রদের সঙ্গে কাজ করলে তাদের চিন্তা চেতনা ধারা প্রভাবিত হয়ে পড়তে পারেন।
৩. সময় নিয়ে ব্র্যান্ড গড়েছেন – আগে টাকা আয় করে পরে ব্র্যান্ড বানাবো এই ফাঁদে পা দেননি। নিজের ব্র্যান্ড গড়ার পিছনে সময় দিয়েছেন। নিজেকে তৈরি করেছেন, প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, জেনেছেন, পড়েছেন।

৪. টিম গড়েছেন – তার নিজের নামেই ব্র্যান্ড হলেও নিজেকে ব্র্যান্ড এম্বাসেডর বানাননি। কর্মীদের তৈরি করেছেন নিজের হাতে। এমনকি তারকাদের কাছে ‘পিচিং’ তার কর্মীরাই করেন।

[আমার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন টুইটার, লিংকডইন, ইউটিউব বা ফেসবুকে।

দৈনিক প্রথম আলো’তে প্রকাশিত আমার লেখা পড়তে পারেন এখান]

Leave a Reply