ট্রাভেলগ : সাঙ্কো পাঞ্জার দেশে-১

Spread the love

প্রাক কথন

বিশ্বের প্রাক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়ুয়াদের জন্য বেশ কটি মেধার প্রতিযোগিতা হয়। খেলাধুলার বড়ো প্রতিযোগিতা যেমনি অলিম্পিক গেমস সেরকম মেধার এই লড়াউগুলোও অলিম্পিয়াড। এরকম অলিম্পিয়াড হয় পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, ভূগোল, পরিবেশ, জ্যোতির্বিদ্যা, জীববিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের। তবে, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বনেদী, সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো গণিতের বিশ্ব লড়াই, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড (আইএমও) সেই ১৯৫৯ সাল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে এই অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অলিম্পিয়াডের বয়স প্রায় ৫০ হতে চললেও বাংলাদেশ কিন্তু সদ্য সেখানে যোগ দিতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির ব্যবস্থাপনায় ডাচ বাংলা ব্যাংক ও প্রথম আলোর পৃষ্ঠোষকতায় ২০০৫ সাল থেকে আমাদের শিক্ষার্থীরা সেখানে যোগ দিচ্ছে। বাংলাদেশের পতাকা যারা সেখানে নিয়ে যায়, তারা নির্বাচিত হয় একটি লম্বা নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। প্রথমে দেশের ১৪টি স্থানে গণিত বিভাগীয় লড়াই, তারপর ঢাকায় জাতীয় অলিম্পিয়াড। সেরাদের নিয়ে গণিত ক্যাম্প, তাদের মধ্যে অর্থাৎ সেরাদের সেরা নিয়ে বর্ধিত ক্যাম্পএইভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে শেষ পর্যন্ন্ত বাংলাদেশ দলের সদস্য হওয়া। ২০০৮ সালের সেই লড়াইএ জয়ী হয়েছে ঢাকার নটরডেম কলেজের সামিন রিয়াসাত নায়েল, কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের তারিক আদনান মুন, চট্টগ্রাম ইস্পাহনীি স্কুলের নাজিয়া চৌধুরী আর ময়মনসিংহ কেবি স্কুলের হক মুহম্মদ ইশফাক। ওদের চারজনের সঙ্গে নাজিয়ার মা, জেসমিন আক্তার। আর পুরো দলের দায়িত্ব নিয়ে উপদলনেতা হিসাবে আমার যাওয়া স্পেনের মাদ্রিদ শহরে ৪৯ তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যোগ দেওয়া।

১৪ জুলাই, মাদ্রিদ, হোটেল ফ্লোরিডা, রাত ১১ টা

ভালয় ভালয় আমরা মাদ্রিদে ঢুকে পড়েছি। আজ সকালে বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে ৬টায় আমরা জিয়া বিমানবন্দরে এসেছি আর এখন ঢাকায় রাত তিনটা। মাদ্রিদে রাত ১১ টা।

সকালে ঢাকা এয়ারপোর্টে চেক ইন আর ইমিগ্রেশনের এ দুই ঘণ্টা সময় লেগেছে। যে কর্মী বোর্ডিং কার্ড দিয়েছে, সে মনে হয় জীবনে প্রথম গ্রুপ চেক-ইন করলো। মাশাআল্লাহ। তার মোটামুটি এক ঘন্টা লেগেছে ৬ জনকে বোর্ডিং পাস দিতে।

তারপর ভেলকি দেখালো ইমিগ্রেশন। যে সব লাইনে আমরা ছিলাম সেখানে ভিড় ছিল। একটা কারণ হলো সকালের এই সময়টাতে মধ্যপ্রাচ্য আর লন্ডনের ফ্লাইট থাকে। ভিড় দেখে এক পণ্ডিত আমাদের ১ নং টার্মিনাল থেকে ২ নম্বরে নিয়ে এলো। সেখানেও কয়েক কাউন্টারে আমাদের ঘোরানো হলো। তারপর যখন আমার পালা আসলো তখন অফিসার প্রথমে আমাকে কিছু জিজ্ঞসাবাদ করলো। সব দেখে বললো- আমি তো আপনার ইমিগ্রেশন করতে পারবো না।”

“কেন?” আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।

তিনি জানালেন তার ডিউটির সময় শেষ হয়ে গেছে, এমনকী তিনি এর মধ্যে কয়েক মিনিট বেশি কাজ করে ফেলেছেন। কাজেই…

কী আর করা আমি আর সামিন আবার অন্য কাউন্টারে দৌড়ালাম। সেখানেও দেখা গেল কিছু একটা নিয়ে বিতর্ক। যাহোক কাতার এয়ার লাইন্সের এক কর্মী এসে তাগাদা দেওয়ায় আমাদের ইমিগ্রেশন কর্ম শেষ হলো এবং শেষমেষ দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা কাতার এয়ারওয়েজের সুপরিসর বিমানে উঠলাম। আমাদের মধ্যে সামিনের এই প্রথম বিমানে চড়া।

আমরা প্রথমে যাবো দোহা। কাতারের রাজধানী। সেখান থেকে আর একটা বিমানে মাদ্রিদ। সাড়ে ৫ ঘণ্টায় জার্নি। বিমানের মনে হয় এখন অনেক খরচ। তেলের খরচ বাচানোর জন্য মনে হয় বিমান চলতে শুরু করার পরই কেবল এয়ার কুলার ঠিকমতো চালানো হলো। ফলে কিছু অসুবিধা হয়েছে।

দোহাতে আমি আগে কথনো যাইনি। কিন্তু যখন জানালা দিয়ে দেখলাম মরুভমির মাঝখানে বিমান দাড়িয়ে পড়েছে, তখন বেশ অবাক হলাম। তারপর দেখরাম সিড়ি লাগানো হলো। বুঝলাম এখানে টার্মিনাল ভবনে সকলেক সরাসরি বিমান থেকে ওঠা বা নামা যায় না। সিডি দিয়ে নেমে আমরা অপেক্ষমান বাসে উঠলাম। টের পেলাম মরুভূমির গরম কাকে বলে। সামান্য সময়ের মধ্যে মনে হলো চামড়া পুরেই গেল!

দোহাতে আমাদের যাত্রাবিরতি মাত্র ১ ঘন্টার। ভেবেছিলাম একটু বিমান বন্দরটা দেখবো। তা সেটা হয়নি। নিরাপত্তা তল্লাসির সময় নাজিয়ার জ্যামিতি বাক্সের জন্য ওকে আটকানো হলো। কম্পাস নিয়ে বিমানে ওঠা যাবে কী না তা নিয়ে নিরাপত্তা কর্মী কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। কম্পাস নিয়ে রওণা হলেন বড়ো কর্তাদের কাছে। ইতিমধ্যে শুনেছে যে, এটা দিয়ে অঙ্ক করা হয়! যাহোক ফিরে এসে তিনি নাজিয়াকে অব্যাহতি দিলেন। আর ইশফাকের শখের ব্যাগ দিয়ে দিল লাগেজে। দোহাতে আমাদের সঙ্গে দেখা হল ফিলিপাইন দলের।

আমাদের ৬টি সিটের মধ্যে জেসমিন আপার সিট হলো জানালার পাশে। ইশফাক আর সামিনের বক্তব্য হলো ওরা চারজন চারবার জানালার পাশে বসবে। ঢাকা থেকে বিমানে বেশ কিছু আসন খালি ছিল ফলে ইশফাক আর মুন চলে গেল জানালার পাশে। দোহা থেকে আবারও ঝগড়া। তবে, নাজিয়াই বসলো। কথা হলো ফেরা সময় আসন পাল্টে দেওয়া হবে।

প্রতিবারই বিমানে ওঠার আগে আমরা কয়েকটা নিয়ম বানাই। যেমন লাইনে দাড়াতে হলে মুন থাকবে সবার আগে আর আমি সবার পেছনে। কোথাও যেতে হলে কমপক্ষে দুইজন একসঙ্গে যাবে। বেশিক্ষণ দলের বাইরে থাকা যাবে না ইত্যাদি। দীর্ঘ সময়ের যাত্রা! আমি অনেকটা পথ ঘুমিয়ে কাটানোর চেষ্টা করলাম। বাকীরা সিনেমা দেখে সময় কাটালো।

মাদ্রিদ ইমিগ্রেশন মনে হয় মুনের পাসপোর্ট দেখে ভড়কে গেল। অথচ আমাদের সামনে দিয়ে হড় হড় করে ঢুকে গেল ফিলিপাইনের দল। দূর থেকে আমরা দেখছিলাম মুন আর একটু পর ইশফাকের পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশনের লোকটা এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। আমার মনে পড়লো ২০০৬ সালে স্লোভেনিয়ায় এই দৌড়াদৌড়ির সময় বেড়ে গিয়েছিল অনেকখানি। শেষ পর্যন্ত প্রায় দুই ঘন্টারও বেশি সময় আমরা লুবিয়ানা এয়ারপোর্টে বসে ছিলাম। তবে, এখানে ততো ঝামেলা হলো না। ঔ কর্মীটি সে প্রথমে মুনকে ছেড়ে দিল। আর আমাদের কাছে জানতে চেয়েছে এক সঙ্গে কী না! বেশি জেরা করেনি।

এই নিয়ে আমাদের চতুর্থবার অংশগ্রহণ। আগের তিনবারই আমরা এয়ারপোর্টে আইএমওর গাইডকে পায় নি। কে জানি এবারও তাই হয় কী না।

তবে মাদ্রিদে লাগেজ পেতে অনেক দেরি হলেও দরজা দিয়ে বের হয়েই আমরা দেখলাম একটি মেয়ে হাতে ” BGD” লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাড়ানো। আমাদে দলের গাইড আলভা। আলভা জানালো আমার আর মুনদের থাকার জায়গা আলাদা। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে দেখলাম সূর্য মামা যথারীতি আকাশে। ঘড়ি দেখি ’রাত’ আট টা!

আলভার’র সঙ্গে আমরা শহরে আসলাম। আমাদের সঙ্গে একই বাসে ছিলো কম্বোডিয়া আর কোরিয়া দল। পথে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেওয়া হল, ওদের জন্য নির্ধারিত ডরমিটরিতে। মনে হয় ৫ জায়গায় ছাত্রদের রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা এসেছি ফ্লোরিডা হোটেলে। রিসেপশনে আমাদের ব্যাগ, ব্যাজ, কাগজপত্র আর হোটেল রুমের চাবি দেওয়া হলো।

রুমে গিয়ে দেখলাম আমার রুমমেট ভারতের উপ-দলনেতা। ঘুমিয়ে পড়েছেন। জামাকাপড় ছেড়ে খেতে গেলাম। গিয়ে শুনি ’ডিনারের সময়’ শেষ! কী আর করা পাশে এক হোটেলে গিয়ে খেয়ে নিলাম। মুনদের কথা ভেবে ভয়ও পেলাম। ওদের আশেপাশে তো কোনো খাওয়ার হোটেলও দেখি নাই!

রুমে ফেরার সময় হোটেলে ইন্টারনেটের খোঁজ নিয়েছি। অনেক খরচ, কিন্তু ফাঁকা থাকে না।

প্রথম রাতেতো অনেক লিখে ফেললাম।

 

 

Leave a Reply