ময়াল-৫

Spread the love

সপ্তাহখানেক পরের কথা। এরই মধ্যে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে জাহিরা। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের মৃত্যুর খবর নিয়ে কোন নতুন তথ্যও নাই। খোঁজও করে না। সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর ফুফু জানালো – ৫ তলার খুশী তোকে খুঁজে গেছে।

খুশীরা ৫m তলায় থাকে। খুশীর ভাই, জসির আহমেদ জাপানের কোন একটা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।

‘ও কেন আমাকে খুঁজে?’

“ওর ভাইকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না কয়েকদিন ধরে। তোর কাছে খবরটা দিতে আসলো, বললো তোদের পত্রিকায় খবরটা ছাপানোর ব্যবস্থা করতে।”

ও আচ্ছা বলে জাহিরা নিজের রুমের দিকে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরেই ফুফুর জোরে ডাক শুনে আবার বসার ঘরে হাজির হলো জাহিরা। বসার ঘরে ফুফুর সঙ্গে গল্প করছে খুশী। জাহিরাকে দেখে বললো- ভাইয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না তিনদিন ধরে। মানে কী। অবাক হলো জাহিরা। জাপানের মতো দেশে কোন লোক হারিয়ে যায় কেমনে?

খুটিয়ে খুটিয়ে সব জেনে নিল।

গত শুক্রবার বিকেলে ক্যাম্পাস থেকে বের হয় জসির আহমেদ। নিজের হাতে ল্যাবে তালা লাগাতে দেখেছে ঐ সময় কয়েকজন ছাত্র। তারপর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যানা। জসিরেরর বউ মানে খুশীর ভাবি কয়েকদিন আগে দেশে এসেছে। কাজে তাদের বাসাটা খালি। জসির যে সেখানে ফিরে নাই সেটা কেউ খেয়াল করেনি।

কাল সোমবার ছাত্ররা ক্যাম্পাসে জসিরকে না দেখে খোঁজ খবর করতে গিয়ে আবিস্কার করে তার ফোন বন্ধ। এর মধ্যে দুইদিন জসির ঢাকাতেও যোগাযোগ করেনি। সেটা অবশ্য ছাত্রদের জানার কথা নয়। ফোনে ই-মেইলে, টুইটারে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দেয়। সোমবার সারাদিন খোঁজ করে পুলিশ কিয়শু থেকে দেড়শ কিলোমিটার দূরে কুশিমা শহরে জসিরের গাড়িটি পরিত্যক্ষ অবস্থায় একটি বোট হাউসে খুঁজে পেয়েছে। খবর পেয়ে আজ দুপুরের ফ্লাইটে খুশির ভাবী জাপান রওনা হয়ে গেছে। খুশি জাহিরাকে জানাতে এসেছে কীভাবে এই ব্যাপারে আরও খোঁজ খবর করা যায় সেটার একটা বুদ্ধি-পরামর্শ করতে।

“ওনার সাবজেক্ট কী ?” জানতে চাইলো জাহিরা।

|ভাইয়া জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর এসোসিয়েট প্রফেসর। জিন ট্রান্সফার না কি জানি নিয়ে কাজ করেন। আমি বিস্তারিত জানি না। আপনি বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারেন।

‘আচ্ছা’, বলে খুশীকে এগিয়ে দিয়ে নিজের ল্যাপটপে বসে পড়লো জাহিরা। আশাহি শিম্বুনে ঢুকে খবরটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো। গুগলের ট্রান্সলেটর টুল ব্যবহার করে পাওয়া নিউজটা পড়ে ফেললো। চোখ আটকে গেল একেবারে নিচের লাইনে। সেখানে লেখা ৬ মাস আগে অস্ট্রেলিয়ার সিডনী থেকে আরও একজন বাংলাদেশী বায়োটেকনোলজিস্ট এভাবে হারিয়ে গেছে। আবদেল মান্নান নামের বাংলাদেশী ঐ তরুন সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি বিভাগে পিএইচডির ছাত্র ছিলেন।

এটা কী কোন চেইন ঘটনা নাকি? জাহিরা ভাবে। আবদেল মান্নানের খোঁজ করার জন্য নিজেদের পত্রিকার আর্কাইভে ঢুকে পড়লো জাহিরা। জানা গেল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তরুন শিক্ষক মাত্র এক বছর আগে সিডনীতে অস্ট্রেলিয় সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়তে এসেছে। বাড়ি চট্টগ্রামে। গত ছয়মাসে তার কোন খবর পাওয়া যায়নি। তবে, দুই পত্রিকার কোনটাতেই আবদেল মান্নানের গবেষণার বিষয়ের উল্লেখ নেই। মনস্থির করে তখনই চট্টগ্রাম রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কাবার্ড থেকে ব্যাকপ্যকটা নামিয়ে নিল জাহিরা।

৬.

ইন্দ্রজিৎ পরিবহনের বাসে একটা যুৎসই সিট পেয়ে গেল জাহিরা। পাশের সিটটা ফাঁকা দেখে ভাবলো ভালই হয়েছে। একটু হাত পা ছড়িয়ে বসা যাবে। বাসে উঠেই মনে হল অনেকদিন সড়ক পথে চট্টগ্রাম যাওয়া হয়নি। বিশেষ করে চারলেন হওয়ার পর। রাতের গাড়িতে যদিও জেগে থাকার তেমন কোন কারণ নেই। কিছুক্ষণ অন্তত নোটখাতা দেখে কাটানো যেতে পারে।
ব্যাগ থেকে কালো কভারের নোট খাতাটা বের করে হাতে নিল। এই নোটবইটি জাহিরাকে দিয়েছে গণিত অলিম্পিয়াডের একাডেমিক টিমের মেম্বার বুয়েটের রূপন্তী। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ওরা দুজনই গণিত অলিম্পিয়াডে ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করেছে। জার্নালিজমের শিক্ষার্থী হওয়াতে জাহিরা সবসময় লেখালেখির কাজটাই বেশি করেছে। আর রূপন্তী প্রশ্ন আর খাতা দেখার টিমে। রূপন্তী অবশ্য এখন দেশে নাই। মনে হয় নর্থ ক্যারোলিনার কোন এক ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। ওরা দুইজন একবার রাঙ্গামাটি উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিল। কিন্তু পথে অনেক হাঙ্গামা হওয়ায় রাঙ্গামাটি পৌছাতে পৌছাতে উৎসব প্রায় শেষ হয়ে যায়। পরে স্যারদের সঙ্গে রাঙ্গামাটির লেকে ঘুরে বেড়ানোতে যোগ দিতে পেরেছিল। ভার্সিটিতে পড়ার সময় শীতকালে গণিত অলিম্পিয়াড টিমের সঙ্গে এদিক-ওদিক বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারটা ছিল এক মহা আনন্দের ব্যাপার। বিশেষ করে যাত্রাপথে, রাত তিনটের সময়  টাইম স্কোয়ারে খিচুড়ি খাওয়ার ব্যাপারটাই আলাদা। খিচুড়ির কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জাহিরার মনে পড়লো ও ঠিক মতো খেয়ে বের হয়নি!

বাসের সুপারভাইজরকে ডেকে জানতে চাইলো, “আপনারা যে ২০ মিনিটের জন্য একটি মাত্র যাত্রা বিরতি দেবেন, সেটা কোথায়?”

জাহিরার গলার স্টাইল যাত্রীদের অনেকেই হেসে দিল। শার্টের পকেটে “নাসিম” লেখা সুপারভাইজর বললো – টাইম স্কোয়ারে!

ও তাহলে খিচুড়ি খাওয়া যাবে। ভাবলো জাহিরা।

ভ্রু কুচকে জাহিরা খাতার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সেখানে অনেক আকিবৃুকি আছে। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের বেঞ্চের পাশে উচু হয়ে থাকা মাটির ঢিবির ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।  মনে হচ্ছে এই ছবি সে আরও অনেক দেখেছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না।

ভাবছে ছয়মাস আগে আবদেল মান্নান আর এখন জসির আহমেদ। দুজনের মধ্যে দুইটা মিল। বাংলাদেশী আর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। কোন সম্পর্ক?

ভাবতে ভাবতে একটু ঘুম লেগে আসলো। ঘুম ভাঙ্গলো একটা ঝাকুনি আর সঙ্গে নাসিমের যান্ত্রিক কন্ঠে – সুপ্রিয় যাত্রীবৃন্দ। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা কুমিল্লার টাইম স্কোয়ারে ২০ মিনিটের একটি মাত্র যাত্রাবিরতি নেবো। এ সময়ের মধ্যে আপনারা আপনাদের প্রযোজনীয় কাজকর্ম সেরে নেবেন। মনে রাখবেন আমাদের গাড়ির নম্বর সাতষট্টি বাহাত্তর।

Leave a Reply