ক্ষুধার্ত থাকো, বোকা থাকো-৬: রাজসিক প্রত্যাবর্তন-১

Spread the love

১৯৯৬ সাল। টয় স্টোরির সুবাদে পিক্সারের নামডাক হয়েছে। ঘুরে দাড়ানো শুরু হয়েছে। তারপরও প্রচুর টাকা বের হয়ে যাচ্ছে। নেক্সট-এর অবস্থাতো আরও খারাপ। তেমন কোন অগ্রগতি নাই। একটা নতুন অপারেটিং সিস্টেম বানানো হয়েছে বটে তবে সেটা এপ্লাই করার কোন জায়গা তো নেই। আর যে কোম্পানির সিইও-এর নাম স্টিভ জবস সেটাই বা কে কিনবে?
জবসের যখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা তখন আমরা তাকে রেখে তার ছেড়ে আসা এপলের খোঁজ নিতে পারি।

ডেস্কটপ পিসির জগতে গোপনে একটা বিপ্লব করে ফেলেছেন বিল গেটসের মাইক্রোসফট। উইন্ডোজের নতুন ভার্সনে অনেক বেশি ফিচার এবং ঝাঁকানাকা। ডেস্কটপ ইউজাররা সেদিকেই বেশি নজর দিচ্ছে। এমনকি ম্যাকের রিপ্লেসমেন্ট হয়ে যাচ্ছে উইন্ডোজ দিয়ে। অন্যদিকে কয়েক বছরের চেষ্টাতেও নতুন কোন অপারেটিং সিস্টেমের প্রপার কোন সলিউশন আনতে পারছে না এপল। একটা বড়ো কারণ সম্ভবত ওএসের ইনচার্জের নিজের কোন ক্ষমতাই নেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
এরই মধ্যে এপল বোর্ড গিল এমিলিওকে এনেছে নতুন প্রধান নির্বাহী করে।  এমিলিও একজন পিএইচডিধারী টেকনোলজিস্ট। ন্যাশনাল সেমিকন্ডাক্টরে একটি নতুন চিপ বানানোতে দারুণ ভূমিকা রেখেছেন। এপল বোর্ড তাকে এনেছে কারিগরি নেতৃত্ব দেওয়া এবং আর্থিক অবস্থা ঠিক করার জন্য। তবে, নতুন ওএস বানানোর চেষ্টা কিন্তু গিলের আগে থেকে। একাধিকবার সভা সমিতি করে গিল বুঝে গেলেন ওএসের দিল্লী দূর অস্ত। বাধ্য হয়ে তিনি চার দেওয়ালের বাইরে তাকাতে শুরু করলেন।

খবরটা প্রথমে জানলেন মাইক্রোসফটের বিল গেটস! তখন উইন্ডোজ এনটি শুরু হয়েছে। বিল তার দলবল নিয়ে  একটা অল-আউট প্ল্যান করলেন এমিলিওকে কনভিন্স করার। বিলের বক্তব্য হলো – মাইক্রোসফটের টিমই এপলের নতুন ওএস তৈরি করে দিতে পারে। এর ইঞ্জিন হবে এনটি!

দ্বিতীয় অপশন হলো সান মাইক্রোসিস্টেমের সানওএস। এমিলিওর টিমের একটা ধারণা হলো এটাই হয়তো তাদের পছন্দেরটা।
তবে, গিল আরও খুঁজতে থাকলেন। আর একটা খোঁজ পাওয়া গেল বীওএস (BeOS)। এটি তৈরি করেছেন এপলের পুরানো কর্মী জ্যাঁ লুই গেসি। এক দশক আগে জবসের চলে যাওয়ার পর এই গেসিই মেকিন্টস টিমের দায়িত্বে ছিলেন।
গিল তিনটাই ইভালুয়েট করার জন্য তিনটা টিমকে দায়িত্ব দিলেন যথাক্রমে তার তিন লেফটেন্যান্টের নেতৃত্বে – ওয়াইনি মেরেটস্কি, উইনস্টন হেনড্রিকসন ও কার্ট পিয়েরসন। প্রত্যেক টিমকে বলা হলো লিখিত মূল্যায়ন দিতে।

এপলের এই দৌড়ঝাপের কথা  কি আর চাপা আছে?

কাজে ঠিক ঠিক জায়গায় খবর চলে গেল। তিন দল যখন ইন্টারনাল রিভিউতে ব্যস্ত তখন একদিন একটা ফোন পেলেন এপলের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা – সিটিও এলেন হ্যানকক।   ফোনটা করেছে নেক্সটের একজন ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়ারের বক্তব্য খুব সোজা – শুনলাম আপনারা নাকি একটি নতুন ওএস খুঁজছেন? আমরাও একটা নিউ জেনারেশন ওএস বানিয়েছি। আপনারা চাইলে দেখতে পারেন। (ধারণা করা হয় এই নাটকটি জবসই সাজিয়েছেন। তিনি নিজে কল না করে অন্যকে দিয়ে করিয়েছেন)।

এলেন বোকা নন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উইনস্টনকে ডেকে বললেন কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে নেক্সট-এর ওএসের খবর নিতে। উইনস্টনের দল ফিরে এসে জানালো নেক্সট-এর ওএসও বিবেচনার যোগ্য।!

ব্যাস গিলের হাত অপশন হয়ে গেল চারটা।

এর মধ্যে মাইক্রোসফটের প্রস্তাবটা আসলে ম্যাকের রাজ্যে ধোপে টেকার কোন কারণ নেই। গিল নিজের ধারণা মতো সানের সঙ্গে অনেকদূর কথা এগিয়ে ফেললেন। কিন্তু, শেষ মুহুর্তে বেঁকে বসলো খোদ সান মাইক্রোসিস্টেম। তারা এপলের জন্য অপারেটিং সিস্টেম বানানোর প্রস্তাব বাতিল করে দিল।
“ডেসপারেট” এমিলিওর হাতে তখন থাকলো কেবল নেক্সট আর বীওএস। এরমধ্যে স্টিভ একদিন পত্রিকার পাতায় পড়লেন গেসির সঙ্গে এপলের ভালই বাতচিৎ হচ্ছে। গিলের ধারণা গেসি ইচ্ছে করেই খবরটা মিডিয়াতে দিয়েছে।

যাইহোক. গিল ঠিক করলেন দুটোরই একটা ফর্মাল লড়াই হোক!!!

তারিখ ঠিক হলো ১৯৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর। পলো আলটোর গার্ডেন কোর্ট হোটেল। এই হোটেল বেঁছে নেওয়ার কারণ হলো রিপোর্টারা যেন খোঁজ না পায়! ঠিক হলো দুই দলই প্রেজেন্টেশন আর ডেমোনেস্ট্রেশন দেবে। প্রথমে স্টিভ জবস আর পরে গেসি।

স্টিভ আসলেন তার ওএস জিনিয়াস এভি টেভানিয়ানকে সঙ্গে করে। প্রেজেন্টেশনের রুমটা বেশ বড়ো। লোকজন বেশি না। একটা ইউ-শেপ টেবিলের এক মাথায় গিল এমিলিও ও তার সিটিও এলেন। মাঝামাঝি এক জায়গায় এপলের সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ ওয়াইন মেরেটস্কি এবং আরও কয়েকজন। আর টেবিলের অন্য মাথায় স্টিভ জবস ও এভি। মানে, স্টিভের সামনা সামনি  গিল আর এলেন। স্টিভ জবস পিচ করবেন এমন একটা কোম্পানির সামনে যে কোম্পানি কিনা তিনিই তৈরি করেছেন!
ভাবা যায়?

কেমন ছিল সেদিনের প্রেজেন্টেশন?

এর একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন মেরেটস্কি। তার জবানবন্দিতে শোনা যাক, “ স্টিভের প্রেজেন্টেশনটা ছিল সরাসরি গিলের উদ্দেশ্যে। মনে হবে ঐ রুমে আর কেউ নাই। জবস তো জানে, কোথায় কোথায় থামতে হবে। কোন ফিচারগুলো এপলের জন্য দরকারি। NeXTStep এর কী কী গুণ। এসব বলতে বলতে ল্যাপটপে তিনি চালালেন একসঙ্গে দুইটা মুভি। দর্শকরা যখন ওয়াও বলবে ঠিক তখনই চালু হলো তৃতীয়টা, তারপর চতুর্থটা এবং সবশেষে পঞ্চমটা! রুমের সবাই আমরা বুঝলাম এমন একটা শক্তিশালী সফটওয়্যার এপলের হার্ডওয়্যারের জন্য কতোটা উপকারী হতে পারে। স্টিভ আবার প্রমাণ করলেন কেন তিনি প্রযুক্তি জগতের সবচেয়ে চৌকস সেলসম্যান”।

স্টিভের পর রুমে আসেন গেসি। গেসির ধারণা ছিল তিনি ডিলটা পেয়ে গেছেন কারণ মাইক্রোসফট আর সানের কথা তো সে জানে। আর স্টিভের কথা সে জানতোই না। কাজে এসেছেন আড্ডার মুডে, কোন প্রস্তুতি ছাড়াই। অগোছালো একটা প্রেজেন্টেশন, বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতে গাইগুই করা। এমনকি এমন কোন বাস্তব যুক্তিও দিতে পারলেন না যাতে বোঝা যায় কেন এপল তার ওএস নেবে।
কাজেই, “নেক্সট আর বীওএসের মধ্য থেকে কোনটা বাছাই করা হবে সেটা বোঝার জন্য বাড়তি ব্রেনের দরকারই ছিল না”।

এসবের কিছুই স্টিভের জানার কথা না। কাজে গিল যখন তার সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন তখনও তিনি কিন্তু জানেন না তিনি ফিরবেন এপলে।

তবে, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে একটু দেখে নেওয়া দরকার জবস কীভাবে এমন সেলসম্যান হয়ে উঠলেন।

আপাতত পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা।

পরের পর্ব – রাজসিক প্রত্যাবর্তন-২

 

 

 

Leave a Reply