ইমোশনাল মার্কেটিং-১১ : চাই সঠিক কৌশল-৪ – ব্যাক টু দ্যা ফিউচার

Spread the love

[সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ – এই পর্বটি একটু বড় আকারের]

ইমোশনাল মার্কেটিং-১১ : চাই সঠিক কৌশল-৩

আজ থেকে ছয় বছর আগে একটা গুগল স্টার্টআপ ইনগ্রেস নামে একটা মোবাইল গেম বাজারে ছাড়ে। এটাতে জিপিএস লোকেশন আর অগমেন্টেডে রিয়েলিটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৪ সালের মধ্যে এর ৭০ লক্ষ ব্যবহারকারী হয়ে যায়। কিন্তু সে কয়েক বছর পরেই আর একটি গেম এ সংখ্যাকে রীতিমতো খেলো বানিয়ে ফেলে।
২০১৬ সালের গেমটি মোটামুটি তরুণ এবং বড়দের প্রায় একই কাতারে নিয়ে আসে। এটিও ঐ ইনগ্রেসের অভিজ্ঞতা আর টেকনোলজির ওপরই বানানো। সব জায়গায় সবাই খুঁজতে শুরু করে।
তাইওয়ানে একজনকে পাওয়া গেল যে কিনা তার সাইকেলে ১১টি স্মার্টফোন লাগানোর ব্যবস্থা করেছে যার সবগুলোতে সে একসঙ্গে ঐ গেম খেলছে। আমেরিকায় টিনএজারদের চোখ এমনভাবে ফোনে সেটে থাকতে শুরু করে যে তারা কি ট্রাফিক কি চেয়ার টেবিল কিছুই পরোয়া করে নাই।
বাধ্য হয়ে অনেক দেশের সরকার সতর্কবানী প্রচার করে। সিঙ্গাপুরে শতো শতো লোক জড়ো হয় যিশুয়ান পার্কে। তারা যেখানে পরের দিন শুরুর সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে একটা কাজ করার জন্য- ক্যাচ দেম অল।
ইনগ্রেসের মতো একই প্রযুক্তি। একইভাবে খেলে। অথচ নতুন গেমটির ডাউনলোড ৮০০ মিলিয়ন ছাপিয়ে গেছে। আর রিলিজের প্রথম সপ্তাহে বানানে ওয়ালা কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৮৬%।

কেন এই উল্লফন? কেন পকেমন গো-এরএই জয় জয়কার?

সহজ বুদ্ধি। মিলেনিয়ালদের নষ্টালজিয়াকে ব্যপকভাবে উসকে দেওয়া!!!

গেম রিলিজের প্রথম কয়েকমাস পরে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পকেমন গো’র খেলুড়েদের বেশিরভাগের বয়স ১৮ থেকে ২৯ বছর। এই তরুণ-যুবাদের ছেলেবলা কেটেছে টেলিভিশনের সামনে, জাপানী এনিমেশন মুভি পকেমন দেখে। সে সময় তাদের ৯৯ শতাংশই মনে মনে ভেবেছে একদিন সেও পকেমন মাস্টার হবে।

যাদের মনে আছে, পকেমন জাপানি টেলিভিশন সিরেজের কথা তারা ঠিকমতো স্মরণ করতে পারবেন। যারা বিটিভিতে দেখেছেন তারাও মনে করতে পারবেন। সে সময় ১২৪টা দেশে জাপানীরা এই ফ্র্যান্চাইজি এনিমে টেলিভিশনে দেখানোর এন্তেজাম করে। পকেমন শব্দটা এসেছে পকেট মনস্টার থেকে। বিশ্বব্যাপী এনিমেকে জনপ্রিয় করার সিংহভাগ ক্রেডিট এই সিরিজকে দেওয়া হয়। জনপ্রিয়তার মাত্রাটা বোঝা যায় অন্যভাবেও। এসব চরিত্র নিয়ে কমপক্ষে ১ হাজার ভিডিও গেম তৈরি হয়েছে!

৯০-এর দশক জুড়ে বিশ্বব্যাপী একদল ছেলেমেয়ের জীবনের অন্যতম লক্ষ ছিল একদিন পকেমন মাস্টার হওয়া। আর পকেমন গো তাদের সেই সেই সুযোগটা করে দিয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ সংক্রান্ত আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এ দলের একজন লিখেছে –  I am one of the oldest players of pokemon go in Bangladesh. We used to play it merely because of our love for the anime Pokemon. (আশির ইন্তিসার)।

আর পকেমন গো ডাউনলোড করার মাধ্যমে এখন সেই সুযোগটা তাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। এ সুযোগ কেই বা ছাড়তে চায়!!! শুধু তাই নয়, অন্য খেলোয়ারদের সঙ্গে তারা একই ইতিহাসও খুঁজে পায়।

টাইম ম্যাগাজিনে মনোবিদ ক্লে রটেডগো’র একটা মন্তব্য ছাপা হয় সে সময়। রটেডগো ১০ বছর ধরে গবেষণা করছেন স্টালজিয়ার ইফেক্ট নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তার বক্তব্য ছিল সহজ – পকেমন গো হলো নস্টালজিয়ার সঙ্গে মডার্ন, এক্সাইটিং প্রযুক্তির “পারফেক্ট ম্যারেজ”!

পেকমন গো’র আবির্ভাবের আগে থেকেই মার্কেটিং-এ নস্টালজিয়ার ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু পকেমন গো’এর পর এটি নতুন মাত্রা পেয়ে যায়। এখন তো নস্টালজিয়া মার্কেটিং ইমোশনাল মার্কেটিং-এর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলে পরিণত হয়েছে।  কোকাকোলার ২০১৫ সালের  শেয়ার-ইট-ফরোয়ার্ড ক্যাম্পেইনের কেন্দ্রেই ছিল ক্লাসিক কোকের কাঁচের বোতল!

নষ্টালজিয়া কেন এতো কার্যকরী? এর কারণ আমার দাদী বলতেন – গেছে দিন ভাল, আসছে দিন খারাপ! যদিও আমি তার সঙ্গে কখনো একমত হতাম না। গ্রীক নস্টোস মানে “বাড়ি ফেরা” আর এলগোজ মানে “বেদনা”। মানে হলো ফিরে যাওয়ার বেদনা। ১৭ শতকে সুইস মার্সেনারীদের বাড়ি ফেরার মনোবেদনা প্রকাশের জন্য সর্বপ্রথম নষ্টালজিয়া শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। এখন ওল্ড ইজ গোল্ডের জন্য আকুলতা প্রকাশের জন্য এ শব্দের ব্যবহার বেড়েছে। সঙ্গে এটাও জানা যে ঐ দিন আর ফিরে পাওয়া যাবে না।

কাজে সহজ বুদ্ধি হলো দর্শক-পাঠককে পুরোনো দিনের কোন চমৎকার স্মৃতির সঙ্গে কানেক্ট করানো। এটি কোন গান হতে পারে, ঐতিহাসিক ঘটনা বা তথ্য হতে পারে। এমনকী পুরোনো দিনের কোন ঠাট্টাও হতে পারে। একটা ভাল উদাহরণ হরো এডোবের “দ্যা জয় অব স্কেচিং” সিরিজ। এখানে একজন অভিনেতা ১৯৮০র দশকের জনপ্রিয় টেলিভিশন পেইন্টার বব রসের ভূমিকায় অভিনয় করে।

গানের ব্যবহারের চমৎকার নিদর্শন হলো আমাদের দেশে ওয়েলকাম টিউন চালুর সময় করা একটি বিজ্ঞাপনে। অফিস থেকে বের হয়ে এক নির্বাহী তার বান্ধবীর সঙ্গে খানা খেতে চলে যায়। এ সময় তাকে অফিসে বস রাগারাগি করে তাকে খোজাখুজি করে। বস ফোন করে নির্বাহীকে। নির্বাহীর ওয়েলকাম টিউন ছিল মান্না দে’র জনপ্রিয় গান – কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আর নেই। গান শুনে বসের মন আদ্র হয়ে যায়! তিন আর রাগ ঝাড়তে পারেন না।

সাম্প্রতিক কালের দুইটি বিজ্ঞাপনে নষ্টালজিয়ার অসাধারণ ব্যবহার দেখা যায়। প্রথমটি গুগলের বিজ্ঞপান। এখানে ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির পর দুই বন্ধুর আলাদা হয়ে যাওয়ার গল্প এবং গুগল করে নাতি-নাতনীর মাধ্যমে তাদের আবার রিকানেক্ট হওয়া। আমার নিজের কাছে এই বিজ্ঞাপনটি একটি অসাধারণ বিজ্ঞাপন হিসাবে চিহ্নিত। এখানে ঐতিহাসিক ঘটনা ও ফ্যাক্টকে তুলে আনা হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন প্রজন্ম (টার্গেট গ্রুপ)কে কৌশলে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। নস্টালজিয়া মার্কেটিং-এর এটি একেবারেই ক্লাসিক একটি উদাহরণ।

আর একটি উদাহরণ মাইক্রোসফটের। নতুন ও ইমপ্রুভড ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের এই বিজ্ঞাপন চিত্রটিতে পুরোনো সেই দিনের কথাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিজ্ঞাপনে ৯০-এর দশকের জনপ্রিয় ট্রেন্ড ও ক্রেজ যেমন তামাগোচি, স্ন্যাপ ব্র্যাসলেট আর ট্রলের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা আছে।

নস্টালজিয়া কেবল ভিডিও দিয়ে করতে হবে এমন কোন কারণ নেই। এই পোস্টের ফিচার্ড ছবিটি দেখুন। কাঁচের বোতলে সফট ড্রিকস! বার্গার কিং-এর সার্জের ফিরে আসার ছবিটি দেখুন।

শুধু হ্যাশট্যাগ দিয়েও এমন নস্টালজিকতার আবরণ তৈরি করা যায়। পেপসির এই ছবিটা দেখা যায়।

অনলাইনের ব্যপ্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারের কারণে এমনতর ক্যাম্পেইন আপনি সবসময় দেখতে পাবেন। টার্গেট গ্রুপকে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করার ধারাবাহিক সফল আয়োজন হলো প্রথম আলোর বিয়ে উৎসব। এখানে একটি পর্ব থাকে বিয়ের ছবির প্রতিযোগিতা। প্রথমে ছবি আহবান করা হয়। তারপর যাচাই বাছাই করে কিছু ছবিকে পাবলিক ভোটের জন্য নির্বাচন করা হয়।

তবে, এসব ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়। কারণ এ সব ক্যাম্পেইনে কিন্তু বিক্রি করা হয় ক্রেস বা ট্রেন্ডকে, নিজের প্রোডাক্টকে নয়। কাজে নিজের ব্র্যান্ড যেন শেষ পর্যন্ত রিলেট হয় সেটা কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে। পুরানো দিনের সুন্দর সুন্দর স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনাটা খুবই ভাল কাজ ব্র্যান্ডিং-এর জন্য, যদি ঠিক মতো ব্যবহার করা যায়।

পরের পর্বের আগেভাগে পড়ে ফেলতে পারেন

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে

ইমোশনাল মার্কেটিং-১৩ : টার্গেট যখন নারী

 

One Reply to “ইমোশনাল মার্কেটিং-১১ : চাই সঠিক কৌশল-৪ – ব্যাক টু দ্যা ফিউচার”

Leave a Reply