আমার বইমেলা ২০১৯-২: সফল যদি হতে চাও – হিউম্যান ডুয়িং নয়, হিউম্যান বিইং

Spread the love

আমার বইমেলা ২০১৯-১: বানিয়ালুলু – সেরার সেরা কল্প বিজ্ঞান

কবি, কথা সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক আনিসুলের হকের সঙ্গে আমার পরিচয় আমি বুয়েটে আসার কয়েক দিনের মধ্যে। এই পরিচয় থেকে সখ্যতার কথা আমি আমার পড়ো পড়ো পড়োতে বিস্তারিত লিখেছি।  পর থেকে আমার সঙ্গে তার কাজ ও আকাজের সম্পর্ক। এখনতো আমরা একই হাউসে, দুইটি পৃথক বিল্ডিং-এ বসি। তবে, আনিস ভাই-এর কবিতাই আমার কাছে প্রথম পছন্দ। সেই “খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে” থেকে। তাই বলে তার এক দুইটা উপন্যাস যে আমি পড়ি নাই তা নয়। তবে, তার গদ্য কার্টুন, অরন্যে রোদন এগুলো নিয়মিত পড়া হয় যেমন পড়া হয় কিশোর আলো’তে যদি তিনি লেখেন।

সে হিসাবে জানুয়ারি ২০১৯ সালে কিশোর আলোর প্রচ্ছদ রচনা – সফল যদি হতে চাও আমার আগেই পড়া। কিন্তু একদিন দেখলাম একই নামে তাঁর একটি বই-এর কভার, ফ্ল্যাপের ছবি তার প্রোফাইলে। খোঁজ নিয়ে জানলাম এই নামে তাঁর একটি বই প্রকাশিত হচ্ছে বইমেলায়।
তো, সেই বইটি এবছর নতুন বই হিসাবে আমার প্রথম কেনা। নগদ ১৮২ টাকা দিয়ে প্রথমা’র বিক্রয়কেন্দ্র থেকে এই বইটা আমি কিনেছি। তারপর দুইদিন ধরে পড়েও ফেলেছি। এর মধ্যে অবশ্য কয়েকটি লেখা আমার আগেই পড়া ছিল। সেগুলোতে একটু নজর বুলিয়ে গেলাম।
আমাদের দেশে এখন মোটিভেশনের জয়জয়কার। মোটিভেশন বক্তা নামে নতুন একটা পেশাও চালু হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন আছে যাদেরকে তারা যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতো সেখান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। মানে তারা তাদের চাকরির প্রতিষ্ঠানেই টিকে থাকতে পারেন নাই। তবে, তারা ভাল মোটিভেশন দিতে পারেন। তাদের কারও কারও বক্তৃতা শুনলে আপনার মনে হবে কোন বিষয়ে দক্ষতার দরকার নাই খালি সুন্দর করে ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেই আপনি লক্ষ লক্ষ টাকা কামাতে পারবেন। কেউ কেউ তাদের ফেসবুক জনপ্রিয়তার সুযোগে অখাদ্য বই লিখে ফেলছে।
এরকম একটা পরিস্থিতিতে আনিস ভাই সফল হওযার কী পরামর্শ দিতে গেলেন সেটা দেখার জন্যই আমি বইটা কিনেছি (না কিনে কী আমার কোন উপায় ছিল?)। তবে আমি এক প্রকার নিশ্চিত ছিলাম তিনি মোটামুটি সফলতা বলতে মানুষের “হিউম্যান বিইং” পরিচয়টাকে মুখ্য করবেন, “হিউম্যান ডুইং” নয়।
আমার সঙ্গে তার একটা ঝগড়াও আছে। তিনি বলেন – মুনির খালি ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করে। আমার ক্যারিয়ার, অন্ট্রাপ্রিনিয়রশীপের আন্দোলন যেন কোনভাবে হিউম্যান ডুইং-এ পরিণত না হয় সেজন্য তিনি আমাকে প্রায়শ আইনস্টাইন অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফজলুর রহমান খানের একটি বিশেষ উক্তি মনে করায় দেন। এফ আর খানের ব্রোঞ্চের একটা মূর্তি আছে আমেরিকায়। মূর্তিটি আছে শিকাগোর মেয়র অফিসের সামনে। এফ আর খান বহুতল ভবন নির্মাণের মূল কৌশলটা উদ্ভাবন করেছিলেন। সিয়ার্স টাওয়ার, জেদ্দা হজ্জ্ব টার্মিনালসহ অনেক কঠিন ও নান্দনিক অবকাঠামোর তিনি স্থপতি ও ডিজাইনার। তো এই লোক বলতেন –প্রযুক্তিবিদদের অবশ্যই তার প্রযুক্তির মধ্যে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়, তাকে অবশ্যই জীবনকে তারিফ করতে পারতে হবে। আর জীবন হচ্ছে শিল্প, নাটক, সংগীত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।

তো, আনিসুল হত আসলে এই বই-এ মানুষ হয়ে ওঠার কথা বলেছেন। উদাহরণ হিসাবে বিশ্বর সেরা মানবদের কথা টেনে এসেছেন। আবার সাধারণ মানুষদের অসাধারণ হয়ে ওঠার কথাও বলেছেন। মার্টিন লুথার কিং, নেলসন মান্দেলা, বঙ্গবন্ধুর কথা এসেছে ঘুরে ফিরে। আবার আমাদের আতাউল করিম স্যার বা জাহিদ হাসানের কথাও এসেছে। ঘুরে ফিরে বলতে চেয়েছেন – পড়ো, পড়ো, পড়ো। বলেছেন পড়তে হবে প্রচুল। এমনকী লেখক হতে হলেও প্রচুর পড়তে হবে।

বই-এ মোট ১৭টি নিবন্ধ আছে। আছে দুইট সাক্ষাৎকার। এর মধ্যে একটি সাক্ষাৎকার আমাদের জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা স্যারের। স্যার খুব সাদামাটাভাবে বলে দিয়েছেন জ্ঞান অর্জন এবং ক্যারিয়ার দুটোই হতে হবে। জীবনকে উপভোগ করতে পারতে হবে। স্যারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আনিসুল হকও বলছেন – জিপিএ পাঁচ পেলে ভাল, না পেলেও মন্দ নয়। কারণ “জিপিএ পাঁচই তোমার জীবন নয়”। অন্য সাক্ষাৎকারটি সৈয়দ মনজুরুল হক স্যারের। স্যার অবশ্য শিক্ষার সঙ্গে চাকরি বা বাণিজ্যের সম্পর্ক একেবারে নাকচ করে দেন।

আমরা যখন ডাচ বাংলা ব্যাংক প্রথম আলো গণিত উৎসব শুরু করি তখন আনিস ভাই প্রায়শ আমাদের সঙ্গে ভাঙ্গা মাইক্রোবাসে করে সারাদেশে যেতেন। ফিরে এসে একটা লেখা লিখতেন। লিখতেন – এই দেশ বদলাবে কারণ এদেশের ছেলেমেয়েরা ৪৩ ডিগ্রী গরমে গণিত করার জন্য মাঠে এসে বসে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে এও বলতেন আমরা যেন কেবল পড়ালেখার মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ করে না ফেলি।
আমার সঙ্গে তার মিল কেবল আমরা দুইজন বুয়েটে পড়েছি তা কিন্তু নয়। আমার মতো তার প্রিয় কবিদের একজন হয়তো আল মাহমুদ। তার একটা কবিতা তিনি এখনও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেন –

তোমরা যখন শিখছ পড়া মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হব, পাখির মতো বন্য।

এই বইটি আনিসুল হক তার সম্পাদিক মাসিক কিশোর আলো’র পড়ুয়াদের উৎসর্গ করেছেন বলে ভাববেন না এই বইটি কেবল কিশোরদের জন্য। আমার মনে হয় শিশু-কিশোর-তরুণদের পাশাপাশি যে সব বাবা-মা নিরন্তর তার সন্তানকে এক ইঁদুর দৌঁড়ে ঠেলে দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত, তাদেরও পড়া দরকার।

সফল যদি হতে চাও
আনিসুল হক
প্রথমা
মূল্য ২৬০ টাকা

One Reply to “আমার বইমেলা ২০১৯-২: সফল যদি হতে চাও – হিউম্যান ডুয়িং নয়, হিউম্যান বিইং”

Leave a Reply