১২০০ ডলারের প্রণোদনা থেকে ১৩ লাখ ডলারের ব্যবসা!

Spread the love

ইলি ডিওপ সন্তান নিয়ে একাই থাকেন আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে। ২০১৯ সালে তাঁর চাকরি চলে যায়। এরপর প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন তিনি। এরপরই বুঝলেন, যা করার নিজেকেই করতে হবে। কিন্তু নিজে কিছু করতে হলে কিছু তো বিনিয়োগের দরকার। সেটা পাবেন কই? কাজেই তেমন একটা এগোল না কিছুই।

কিন্তু ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমেরিকাও দীর্ঘ সময়ের লকডাউনে চলে গেল। সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকদের দেওয়া হলো ১ হাজার ২০০ ডলারের প্রণোদনা। প্রণোদনার চেক হাতে পেয়ে ইলি ভাবলেন স্বপ্ন পূরণের কথা—নিজের পেছনে আর তাঁর ‘ভবিষ্যৎ’ উদ্যোগের উন্নয়নে এই অর্থ খরচ করা যেতে পারে। গড়ে তুলবেন একটি কোচিং স্টার্টআপ।

কী করা যায়

অতিমারিতে ইলি দেখলেন, মিলেনিয়ালদের (যাঁদের জন্ম ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে। অর্থাৎ এখন যাদের বয়স ২৫ থেকে ৪০) মধ্যে ব্যবসা করার আগ্রহ এবং উদ্যোগ বেড়েছে। [করোনাকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনলাইন ও অফলাইন উদ্যোক্তার সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪৫ লাখ ব্যক্তি উদ্যোক্তার খাতায় নাম লিখিয়েছেন আমেরিকায়। এই সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়ে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি! ২০১০-১৯ সালের বার্ষিক গড়ের চেয়ে এটি প্রায় ৫১ শতাংশ বেশি। এদের একটি বিরাট অংশই করোনার কালে হয় চাকরি খুইয়েছেন অথবা স্বপ্রণোদিত হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।] ইন্টারনেটের বিভিন্ন ফোরামে ইলি দেখলেন, এই হবু উদ্যোক্তারা কীভাবে ব্যবসা শুরু করতে হবে, সেটা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন, জানতে চাইছেন। সম্প্রতি বিজনেস ইনসাইডারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইলি বলেন, ‘আমি দেখলাম, কিছু প্রশ্নের কেউ কোনো উত্তর দিচ্ছে না। বেশির ভাগ বিজনেস কোচই পুরুষ কিংবা সন্তানহীন নারী। আর যেসব নারীর সন্তান আছে, তাদের কোনো না কোনো রিলেশনশিপ আছে। আমার মতো কাউকে দেখলাম না কিংবা আমার দৃষ্টিভঙ্গির কেউ সেখানে নেই। ঠিক করলাম, আমিই সেই লোক হব।’

কাজেই ইলি ডিওপ ২০২০ সালে মিলেনিয়ালদের ব্যবসা শুরু করা, ব্যবসার জন্য বিনিয়োগ, ক্রেডিট এবং অনুদান সংগ্রহে সহায়তা করার জন্য ‘ইলি টকস মানি (Ellie Talks Money)’ নামে একটি অনলাইন কোচিং স্টার্টআপ চালু করেন। ১০ মাস পরে এখন দেখা যাচ্ছে, তাঁর একক স্টার্টআপ এরই মধ্যে এক মিলিয়ন ডলারের বেশি রাজস্ব আয় করে ফেলেছে!

প্রণোদনার টাকা স্টার্টআপে বিনিয়োগ

ইলি প্রথমে খুঁজে বের করলেন কোন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি তাঁর জন্য ভালো হবে। বিশেষ করে, কম খরচে নিজের মার্কেটিং করে উদ্দিস্ট কাস্টমারের কাছে পৌঁছানো যাবে। নিজের পণ্য ও সেবা তৈরি হওয়ার পর সেটির খবর পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে। দেখেশুনে ঠিক করলেন ইনস্টাগ্রামেই তিনি ফোকাস হবেন। নিজের করপোরেট চাকরিজীবনে ইলি প্রতিষ্ঠানের হয়ে ইনস্টাগ্রাম ম্যানেজ করতেন এবং জানেন কীভাবে কম খরচে সেখানে আকর্ষণীয় পোস্ট দেওয়া যায়। ‘আমার করপোরেট অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শুরু করার উদ্যোগ নিলাম। জানতাম, আমার লাগবে ওয়েবসাইট, ভালো আলোর ব্যবস্থা এবং ছবি ও ভিডিও সম্পাদনা টুল, যার মাধ্যমে আমার প্রথম পণ্য তৈরি করতে পারব।’

ইনস্টাগ্রামে খুললেন নিজের পেজ ইলি টকস মানি

১৭০ ডলার খরচ করে আলোর ব্যবস্থা করলেন, যাতে তাঁর ছবিগুলো ভালো হয়। যেহেতু বেশি টাকা নেই, তাই ঠিক করলেন ওয়েবসাইট নিজেই বানাবেন। ডোমেইন কেনা, এক বছরের জন্য হোস্টিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং ওয়েবসাইট বানাতে তাঁর মোট খরচ হয়ে হলো ১৪৫ ডলার।
ইনস্টাগ্রামে কাঙ্ক্ষিত টুলের জন্য গবেষণা শেষে ইলি ক্যানভা প্রো (https://www.canva.com/pro/)-এর মেম্বারশিপ কিনলেন ১২০ ডলারে।

গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং

৪৫০ ডলার খরচ হয়ে গেল শুরুর শুরু করতে। এ জন্য ইলি ঠিক করলেন মার্কেটিংয়ে খুব বেশি খরচ করা যাবে না। এ জন্য তাঁকে গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন বুদ্ধি ব্যবহার করতে হবে। তবে আলো, ওয়েবসাইট তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন না। টানা ৪৫ দিন ধরে প্রতিদিন নিয়ম করে ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করেছেন। পোস্ট ও হ্যাশট্যাগ নিয়ে রিসার্চ করেছেন। ‘এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে এ কাজে যাঁরা সফল, তাঁরা কী করছেন, সেটা জানা এবং কোন চাহিদাটা তাঁরা পূরণ করছেন না।’ এরপর তিনি পেজে সক্রিয় হলেন।

ইলি প্রথমে ফ্রি কনটেন্ট দিলেন, যাতে তাঁর উদ্দিষ্ট লোকেরা আকৃষ্ট হয়। তারপর তিনি ১৫০ ডলারের মতো খরচ করলেন বিজ্ঞাপনের (বুস্ট) পেছনে। এভাবে কিছু টার্গেট ব্যক্তিকে পেজের অডিয়েন্স হিসেবে পাওয়ার পর ইলি তাঁর প্রথম প্রোডাক্টটি তৈরি করলেন। যেহেতু মার্কেটিংয়ের জন্য তেমন কোনো অর্থ আর নেই, ইলি তাই বেছে নিলেন গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং পদ্ধতি। তিনি শুরুতে বিনা মূল্যে তাঁর কোর্স অফার করলেন। শর্ত দিলেন যে কোর্স কাজে লাগলে অংশগ্রহণকারীরা সেটির রিভিউ দেবেন। দুই সপ্তাহজুড়ে এ কাজ করে ইলি বেশ কিছু ভালো টেস্টিমোনিয়াল জোগাড় করে ফেললেন।

নিয়মিত সামঞ্জস্যপূর্ণ উপস্থিতি

যখন ইলির পেইড কোর্সের প্রচারণা শুরু হলো, তখন থেকে তিনি প্রতিদিন ইনস্টাগ্রামে লাইভে হাজির থাকলেন। সেখানে তিনি দর্শকদের নানা প্রশ্নের জবাব দিলেন। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য তাঁর পরামর্শ, ‘অডিয়েন্সের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করুন। কারণ, তাদের তো আপনাকে পছন্দ করতে হবে, বিশ্বাস করতে হবে। তাহলেই তারা ফিরে ফিরে আসবে। আর এখানে কোনো ফাঁকিজুকি চলবে না। নিজেকেই ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে।

ইলি কেন সফল হলেন

ইলি ডিওপের এই সাফল্যের কারণ খুঁজে দেখা যেতে পারে। আমার বিবেচনায় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে তার সাফল্যের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

১. বাজার বিশ্লেষণ ও সমস্যা খুঁজে বের করা: ইলি কিন্তু কোনো একটা ধারণা নিয়ে সরাসরি মাঠে নেমে যাননি। তিনি করোনাকালের বিভিন্ন বিষয় লক্ষ করেছেন, যার সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতা যেতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করে তিনি এমন সমস্যা খুঁজে পেয়েছেন, যার সমাধান তিনি করতে জানেন।

২. মানসম্মত প্রোডাক্টের জন্য বিনিয়োগ: ইলি জানেন, যে সেক্টরে তিনি কাজ করতে চান, সেখানে অনেকেই কাজ করছেন। এমন একটা ক্ষেত্রে কাজ করতে হলে তাঁর প্রোডাক্টগুলোকে মানসম্মত হতে হবে। আর সে জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও টুলস কিনতে হবে। খেয়াল করুণ, ইলি কিন্তু বিনা মূল্যের কোনো টুলস বা উপকরণের পেছনে অহেতুক সময় নষ্ট করেননি। রিসার্চের ফলাফল অনুসারে দ্রুত সেটি কিনেছেন বা গ্রাহক হয়েছেন।

৩. প্ল্যাটফর্ম নির্বাচন: প্রস্তুতি নেওয়ার পর ইলি প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোনটি তাঁর জন্য ভালো হবে, সেটি খুঁজে বের করেছেন এবং একটি মাধ্যমেই নিজেকে ফোকাস রেখেছেন।

৪. অন্যরা কে কী করছে বা করছে না: ইনস্টাগ্রামে পেজে খোলার পর ৪৫ দিন পর্যন্ত ইলি কোনো পোস্টই দেননি! এ সময় তিনি ভালোভাবে ইনস্টাগ্রামের ধরন, এলগারিদম—এসব জেনেছেন। তারপর চিহ্নিত করেছেন কোচিং ব্যবসাতে সফল ব্যক্তিদের এবং লক্ষ করেছেন তাঁরা কীভাবে কী কী করছেন। মনোযোগের সঙ্গে বের করেছেন সেক্টরের গ্যাপটা কোথায় এবং সেটার জন্য নিজেকে তৈরি করেছেন।

৫. গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং: মার্কেটিং করার জন্য ইলির অনেক অর্থ ছিল না। কাজেই তিনি বেছে নিয়েছেন গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং পলিসি। শুরুতে কিছু ভালো কনটেন্ট দিয়ে তাঁর পেজে লোকজনকে আকৃষ্ট করেছেন, কিছু পেইড প্রমোশন করে কাঙ্ক্ষিত গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। তারপর একটি প্রোডাক্ট তৈরি করে সেটি বিনা মূল্যে অফার করেছেন এবং বিনিময়ে বেশ কিছু ভালো টেস্টিমোনিয়াল জোগাড় করেছেন। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তাঁর প্রোডাক্টের ‘সোশ্যাল প্রুফ’ জোগাড় করতে পেরেছেন। তারপরই তিনি তাঁর পেইড কোর্সের প্রচারণা শুরু করেছেন।

৬. নিজেকে প্রতিনিয়ত সম্ভাব্য গ্রাহকদের সামনে হাজির করা: পেইড প্রোডাক্টের প্রচারণা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ইলি তাঁর পেজে প্রতিদিন লাইভ করতে শুরু করেন। উদ্দেশ্য সম্ভাব্য গ্রাহকদের সামনে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিজেকে তুলে ধরা। এর ফলে হবু গ্রাহকেরা দেখেছেন তিনি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন। এ থেকে তাঁরা ইলির মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস খুঁজে পেয়েছেন।

 

[তথ্যসূত্র বিজনেস ইনসাইড। প্রথম প্রকাশ দৈনিক প্রথম আলো ২৪ মে ২০২১]

Leave a Reply