পড়ো পড়ো আবার পড়ো – বুড়ো আংলা

Spread the love

বুড়ো আংলা আমি ছোটবেলাতে পড়ি নাই। কেন এটা বাদ পড়েছে সেটা জানি না। বুয়েটে পড়তে আসার পর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র অথবা আইসানউল্লাহ হলের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়া। পড়ার সময় একটা ঘোরের মধ্যে পরে যাওয়া। সেটাই হয়েছে।

‘ছবি লেখার ওবিন ঠাকুরের’ বুড়ো আংলা গতকাল আর আজ সকালে আবার পড়েছি। উদ্দেশ্য  সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করা। লেখকদের স্মরণ করার সোজা তরিকা হলো তাদের বই পড়া।

‘বুড়ো আংলা’ বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ঘটনা বলে আমার মনে হয়। আর ছবির লেকক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখালেখিতে আনার জন্য আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ধন্যবাদ দিতে পারি। ওবিন ঠাকুর বাচ্চাদের বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনাতেন। সেটা থেকেই কবিগুরু থাকে লেখার কথা বলেন এবং আস্তত্ব করেন যে বানান-টানান তিনি দেখে দেবেন।
বুড়ো আংলা অনেকেরই পড়া। কাজে এর কাহিনী পুনরাবৃত্তি করাটা হয়তো ঠিক নয়। কিন্তু আমার নিজের ভাল লাগা আর আক্ষেপের জায়গাটা বোঝার জন্য আমরা সেটা একটু নজর বুলিয়ে আসি।

‘বুড়ো আংলা’ আমতলি গ্রামের রিদয়ের গল্প। নাম রিদয় হলেও সে মোটেই হৃদয়বান নয়। ১২ বছর বয়স হওয়ার আগেই সে মোটামুটি তার আশেপাশের সবাইকে জ্বালাতন করে শেষ করেছে। “পাখির বাসায় ইঁদুর, গরুর গোয়ালে বোলতা, ইঁদুরের গর্তে জল, বোলতার বাসায় ছুঁচোবাজি, কাকের ছানা ধরে তার নাকে তার দিয়ে নথ পরিয়ে দেওয়া, কুকুর ছানা বেরাল ছানার ল্যাজে কাঁকড়া ধরিয়ে দেওয়া, ঘুমন্ত গুরুমহাশয়ের টিকিতে বিচুটি লাগিয়ে আসা, বাবার চাদরে চোরকাঁটা বিঁধিয়ে রাখা, মায়ের ভাড়ার ঘরে আমসির হাড়িতে আরশোলা ভরে দেওয়া –এমনি নানা উতপাতে সে মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সবাইকে এমন জ্বালাতন করেছিল যে কেউ তাকে দুচক্ষে দেখতে পারতো না”।
এ হচ্ছে রিদয়। সারক্ষণ সে কোনো না কোনো দুষ্টামীর ফন্দী আটে। আর সেরকম গণেশঠাকুরকে বন্ধি করতে গিয়ে তার শাপে হয়ে যায় বুড়ো আঙ্গুলের সমান বা বুড়ো আংলা।

এখন কী করে? দেবতা গণেশ যেহেতু তাকে শাপ দিয়েছে কাজে তার কাজ হবে কৈলাসে গিয়ে দেবতার কাছে মাফ চেয়ে শাপের অন্ত করা! এ জন্য সে ঘর ছেড়ে বের হয়ে পরে। শুরুতে হেটে যাওয়ার মনস্থ করে কিন্তু অচিরেই সে উঠে পরে তাদের বাসার খোঁড়া সুবচনী হাসের পিঠে। সে সময় সন্দীপ থেকে একদল যাযাবর পাখি নিজেদের দেশে ফিরে যাবার সময় আমতলির ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। সুবচনীর পিঠে চরে বুড়ো আংলা সেই দলের অংশ হয়ে পড়ে।
তারপর তাদের উড়ে উড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাওয়া। কখনো ওপর থেকে নিচের প্রাণিদের সঙ্গে কথা বলে হালহকিকত জানা আবার নিজেরা নেমে আসা – সবই একে এক ঘটতে থাকে। উপর নিচের পাখিদের আলাপের একটি ছোট্ট বর্ণণা পড়লেই আমরা বুঝতে পারবো কেন এই বইটি অন্যরকম।

রিদয়কে নিয়ে চলতি হাসেরা পাহাড় থেকে একদল ফিরতি হাসকে শুধিয়ে জানলে –ওধারে এখনো কুয়াশা কাটেনি ; শিল পড়ছে ; জল হিম ; গাছে এখনো ফল ধরেনি! অমনি তারা টিমে চালে চলতে আরম্ভ করলে । তাড়াতাড়ি পাহাড়-অঞ্চলে গিয়ে লাভ কী, বলে তারা এগ্রাম-সেগ্রাম, নদীর এপার-ওপার করতে করতে ধীরে সুস্থে এগোতে থাকল।

গ্রামে-গ্রামে ঘরের মটকায় কুঁকড়ে সব পাহারা দিচ্ছে । ঘাটিতে-ঘাটিতে চলন্ত পাখিরা তাদের কাছে খবর পাচ্ছে।
‘কোন গ্রাম ? তেঁতুলিয়া, সাবেক তেঁতুলিয়া, হাল তেঁতুলিয়া।
‘কোন শহর ? নোয়াখালি—খটখটে।
‘কোন মাঠ ? তিরপুরনীর মাঠ— জলে থৈথৈ “
‘কোন ঘাট ?’ ‘সাঁকের ঘাট — গুগলী ভরা।’
‘কোন হাট ? উলোর হাট—খড়ের ধুম ?
‘কোন নদী ? ‘বিষনদী-ঘোলা জল ।’
‘কোন নগর ? ‘গোপাল নগর—গয়লা ঢের’।
‘কোন আবাদ ? ‘নসীরাবাদ–তামুক ভালো।
‘কোন গঞ্জ ? বামুনগঞ্জ-মাছ মেলা দায়।
‘কোন বাজার ? হালতার বাজার-পলতা মেলে।’
‘কোন বন্দর ? ‘বাগা বন্দর-হুক্কাহুয়া।’
‘কোন জেলা ? ‘রুরুলী জেলা—সিঁদুরে মাটি ।
‘কোন বিল ? ‘চলন বিল—জল নেই।
‘কোন পুকুর ? বাধা পুকুর—কেবল কাদা৷”
‘কোন দীঘি ? ‘রায় দীঘি-পানায় ঢাকা ।”
‘কোন খাল ? বালির খাল—কেবল চড়া।”
‘কোন ঝিল ?’ ‘হীরা ঝিল— তীরে জেলে”।
‘কোন পরগণা ? পাতলে দ—পাতলা হ ’
‘কোন ডিহি ? ‘রাজসাই-খাসা ভাই ।
‘কোন পুর ? পেসাদপুর— পিপড়ে কাদে।
‘কার বাড়ি ? ঠাকুর বাড়ি।
‘কোন ঠাকুর ? ‘ওবিন ঠাকুর-ছবি লেখে।
‘কার কাচারি ? নাম কোরো না, ফাটবে হাড়ি।

পড়তে পড়তে মন চলে যায় ছোটবেলায়।  এই খেলাটা আমরা খেলতাম – কথার পিঠে কথা যোগ করে।

‘একটা কথা আছে’
‘কী কথা?’
‘ব্যাঙের মাথা’
‘কী ব্যাঙ?’
‘সরু ব্যাঙ।’


সেটাকে কী চমৎকার করে লেখক এখানে নিয়ে এসেছেন।

পড়তে পড়তে কখন যে আমি নিজে সুবচনী হাসের পিঠে সওয়ার হয়ে পাখির চোখে বাংলা দেখতে শুরু করেছি সেটি টের পাইনি। ওবিন ঠাকুর কেমন করে পাখির চোখে বাঙলা দেখেছেন সে আমি জানিনে, কিন্তু এখন মনে হয় ড্রোন দিয়ে ভিডিও বানালে ঠিক এমনটিই আমরা দেখতে পাবো।

এই প্রচ্ছদটি করেছেন সত্যজিত রায়

ঘটনার আর প্রকৃতির বর্ণনার মাঝে ওবিন ঠাকুর কিন্ত তাঁর কাজ ভুলেননি। তাই দেখা যায় প্রাণিকুলের আতঙ্ক রিদয় কিন্তু ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে পাখ-পাখালির বন্ধু। খেঁক শিয়ালের মুখ থেকে ছিনিয়ে আনছে লুসাই পাখিকে, ডালকুত্তাকে প্রতিহত করে বাঁচিয়ে দিচ্ছে  সুবচনী হাঁসকে। আর এভাবেই বই গড়াতে থাকে শেষের দিকে। সেটুকু আর না বলি।

বুড়ো আংলা পড়ার সময় আমার মোটেই মনে হয়নি আমি পড়ছি। মনে হচ্ছিল ওবিন ঠাকুর আমার পাশে বসে আমাকে বুড়ো আংলার গল্প শোনাচ্ছেন! আমরা যেমন বলার সময় বিড়ালকে বেরাল বলি তেমনি তিনি তাই বলছেন, নির্ভিক না বলে নিডর বলছেন। মুখের ভাষাতেই তাই বুড়ো আংলা হয়ে উঠেছে এক আশ্চর্য কাহিনী।

সেই ৩৩ বছর আগে পড়ার সময় যে আক্ষেপে মন পুড়েছে সেটা আবার নতুন করে ফিরে এসেছে। ওবিন ঠাকুরের বুড়ো আংলা যদি লেখা হতো ইংরেজি কিংবা জাপানী ভাষায় তাহলে এতোদিনে বুড়ো আংলা হয়ে উঠতো চমৎকার এক কার্টুনের চরিত্রি বা অ্যানিমে । মোগলির পাশাপাশি সারা পৃথিবীর শিশুদের মনে বড় জায়গা জুড়ে থাকতো তার বীরত্বের কাহিনী, পাখিদের জন্য তার ভালবাসা এবং লক্ষ্যের পথে অবিচল এগিয়ে যাওয়া।

আমি জানি না এখন যারা এনিমেশন ছবি বানান তারা এই চমৎকার শিশু সাহিত্যের দিকে নজর দেবেন কিনা। দিলে সেটা হবে ওবিন ঠাকুরের সার্ধশত বছরের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সব ছেলে-বুড়োরই ‘বুড়ো আংলা’ পড়া উচিত। বাবা-মা’দের দরকার সন্তানদের এটি পড়তে দেওয়া দেওয়া। রকমারিসহ নানান বই-এর দোকানে পাবেন। পিডিএফও পাওয়া যায় ইন্টারনেটে।  এমনকী যারা উদ্যোক্তা বা মার্কেটার হতে চায় তাদেরও এই বইটি খুব কাজে লাগবে। কারণ স্টোরিটেলিং-এর এমন বই খুব একটা পাওয়া যাবে না বাংলা ভাষাতে। যে গল্প শুরু হলে আর থামতে ইচ্ছে করে না সেরকম গল্পের একটি সাক্ষাত উদাহরণ এটি। কাজে লাগবে উদ্যোক্তা ও গ্রোথ হ্যাকারদের।

সার্ধশত বর্ষে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য আমার ভালবাসা।

[আমার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন টুইটার, লিংকডইন, ইউটিউব বা ফেসবুকে]

Leave a Reply