সবার জন্য শিক্ষা-২:দুর্জয় তারুণ্যকে রুখবে কে

Spread the love

আমার বাবা ভ্যান গাড়ি চালাতেন। আমি কস্টে-সৃষ্টে স্কুলে পড়তাম। এসএসসি পরীক্ষার পরপরই বাবা একটা এক্সিডেন্ট করেন। তার একটা পা এমন হয়ে যায় যে, ঠিকভাবে ভ্যান চালানো সম্ভব নয়। আমি তখন গঞ্জের হোটেলে চাকরি নিলাম। বাবার পাশে দাড়ানোর জন্য। সারাদিন কাজ করি আর ভাবি পরীক্ষার ফলাফল কেমন হবে?
রেজাল্টের দিন জানলাম আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছি। খুব খুশী হলাম। সেই সঙ্গে মনে দু:খও পেলাম। কারণ আমারতো আর পড়ালেখা হবে না। আমার মনের অবস্থা দেখে হোটেল মালিক আমাকে বললেন- তোমার আর কাজ করার দরকার নাই। বগুড়া গিয়ে কলেজে ভর্তি হও। আমি তোমাকে পড়ার খরচের ব্যাপারে সাহায্য করবো।
কিন্তু আমি যদি চলে যাই তাহলে সংসারের কী হবে? এসব ভেবে আমি আর আগ বাড়াই না। মালিকের কথা শুনে বাবা-মা বললেন – আমাদের একটা কিছু হবে। তুই বগুড়া যা।
পরে, সবার পরামর্শ বাজারে বাবার জন্য একটা জায়গা টিক করলাম যেখানে বাবা পান বিক্রি করতে পারবেন। দিনশেষে যেতে পারবেন। তাতে হয়তো আমাদের একটা কিছু হবে।
সেটি হওয়ার পর আমি বগুড়া এসে আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হলাম। তারপর আবার মন খারাপ। কারণ বিজ্ঞানের বিষয়গুলো খালি নিজে পড়ে বুঝতে পারি না। সবাই প্রাইভেটে পড়ে। আমি তো খাওয়ারই খরচ যোগাতে পারি না। তাহলে?
কেমনে জানি একজন স্যার দয়াপরবশ হয়ে আমাকে তার ব্যাচে আসতে বললেন- তোমার থেকে কোন টাকা দিতে হবে না।
আমি ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি পড়তে শুরু করলাম। আর একজন স্যার গণিত করানো শুরু করলেন। আমার একটা সাইকেল ছিল। সেটা চালিয়ে আমি গণিতের স্যারের বাসায় যেতাম। একদিন সাইকেলটা চুরি হযে গেল। আমারও গণিত পড়া বন্ধ হযে গেল।
যাই হোক লড়ে গেলাম। এইচএসসিতে ভাল রেজাল্ট করলাম। বাবা-মা এবার বাড়ি ফিরতে বললেন। আমিও তাই করলাম। কিন্তু মনে মনে ইচ্ছা যে, আমি অন্তত কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দেব। কোচিং করতে না পারি পরীক্ষাতো দিতে পারবো।
তো, সেই মতে মেডিকেলে পরীক্ষা দিয়ে আমি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে গেলাম। কিন্তু ভর্তি হবো কেমনে। পরে ধার-দেনা করে ভর্তির টাকাও যোগাড় করলাম। কিন্তু পড়ার খরচ?
একদিন আমি সাইফুর ভাই-এর কথা শুনলাম। তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারপরই আমার চিন্তাটা চলে গেল।
সাইফুর ভাই আমার ভর্তির সময়ের ধারের টাকাটা শোধ করে দিলেন। আর আমাকে “সবার জন্য শিক্ষা” প্রকল্পের অংশ করে নিলেন। আমি এখন মাসে মাসে আমার পড়ার খরচ পাই ওনাদের কাছ থেকে।
শুরুতে ইংরেজির কারনে আমার খুব অসুবিধা হতো। কিন্তু মনকে বোঝাতাম- ভাইয়ারা আমার জন্য এতো করছেন। তাহলে আমি কেন আর একটু কষ্ট করবো না। এখন আমি নিয়মিত ছাত্র হিসাবে ঠিক মতো পড়াশোনা করছি।
ডাক্তার হয়ে আমিও একদিন ভাইয়াদের সঙ্গে এই কাজে যুক্ত হযে যাবো।

চেয়ারে বসে বসে এই কথাগুলো শুনছিলাম। একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সবার জন্য শিক্ষার স্পন্সরদের কয়েকজন আর দ্বিতীয় ব্যাচের যাদের ভর্তি যুদ্ধ শেষ হবে ৩০ তারিখে তাদের জমায়েত। ৩০ তারিখের পর তাদের সঙ্গে ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ।

তো, আমরা শুনছিলাম তাদের কথা। সলিমুল্লাহর আলমের মতোই রকিবুল পড়ে বুয়েটে। ও অবশ্য এসএসসি পরীক্ষার পর থেকেই সবইফুরদের সবার জন্য শিক্ষার একজন। এছাড়া ছিল ২য় ব্যাচের ২০ জন। এদের ৯ জনই এর মধ্যে এক বা একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। বাকীরা পেয়ে যাবে এমনটাই সবার বিশ্বাস।
গত ছয় মাস ধরে ঢাকায় মোহাম্মদপুর একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। আর বিভিন্ন কোচিং-এ দৌড়ায়। রাতে এসে জড়ো হয় আর পড়তে শুরু করে।কারণ ওরা জানে কেবল ভাল একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেই তবেইনা এই ভাইয়াদের পরিশ্রম এবং সহায়তাটা কাজে লাগবে। ওরা কেও হারতে চায় না।
এবার যারা কুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল তারা হলে বেড শেয়ার করে থাকতে পারে নাই। ওদের জন্য হোটেল ভাড়া করতে হয়েছে। এটা ওদেরকে পীড়া দিয়েছে। কারণ এত্তোগুলো টাকা! তাই আমি যখন জানতে চেয়েছি এখন তোমারা কেমন করে আমাদের সঙ্গে কাজ করবে তখন ওরা নিশ্চিন্তে বলেছে – আগামীবার আমার হলের সিটে এডুকেশন ফর অলের পরিক্ষার্থীরা থাকবে, আমি যখনই সময় পাবো বুয়েট থেকে চলে যাবো ওদের কাছে, প্রথম ব্যাচের কয়েকজন পড়ালেখার সাপোর্টের জন্য বিভিন্ন নোট, শীট তৈরি করছে তাদের সঙ্গে লেগে পড়ব।
ওরা আরো অনেক কথা বলেছে। সেটি হয়তো অন্য কোন দিন বলা যাবে। আজকে শুধু বলি ওরা পণ করেছে – ওরা দুর্নীতি করবে না।

এই সবের ফাঁকে ফাঁকে আমরা আলাপ করেছি নতুনদের আরো কীভাবে সহায়তা করা যায়। এই কাজকর্ম সম্পর্কে আমি আগে লিখেছি। যারা জানেন না তারা সেটা দেখে নিতে পারেন।
এবারের ২০ জনকে একটা বাড়িতে রেখে ভর্তি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আগামী বছর এটা ৫০ জন এবং পরের বছর ১০০ জন হবে। তখন এরকম একটা ভাড়া বাড়িতে রাখাটা কঠিন হবে। সেজন্য ভাবা হল যদি একটা ৫তলা বাড়ি একেবারে কয়েক বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে নেওয়া যায় তাহলে অনেক ভাল হবে। সেটিকে একটি ডরমিটরি কাম ট্রেনিং সেন্টার হিসাবে গড়ে তোলা যাবে। শুধু ভর্তি সহায়তা নয় সেক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে ইংরেজি প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে আরো নানান উদ্যোগ নেওয়া যাবে। মোহাম্মদপুর, সাতারকুল, বেড়িবাধ ইত্যাদি এলাকায় এখন থেকেই খোঁজ খবর ওরা করবে।

রাতে বাসায় ফেরার সময় মনে হয়েছে দুর্জয় তারুণ্যকে রুখবে কে।

আল্লাহ ওদের সবাইকে এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা দিন।

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version