গড়ের মাঠে গড়াগড়ি

Spread the love

যদি বলি, কয়েকটি খেলায় তামিমের মোট রান ১৫৩ আর সাকিবের ১০২। তাহলে কে ভালো ব্যাট করে?
তাহলে সিংহভাগ পাঠকই হয়তো লাফিয়ে উঠবেন, ‘কেন, তামিম।’
তবে, কয়েকজন ভ্রুকুঁচকে জানতে চাইবেন, ‘আচ্ছা, দুজনই কি সমানসংখ্যক ম্যাচ খেলেছে?’
ঠিক। ব্যাপারটা আসলে তাই। কারণ, যদি এমন হয় ১৫৩ রান তামিম করেছে দুই ম্যাচেআর সাকিবের ১০২ এক ম্যাচে, তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ থাকে না। থাকেনা বলেই গণিতজ্ঞরা গড়ের ধারণার আমদানি করেছেন।
সাধারণভাবে একই ধরনের রাশির ব্যাপারে যদি কয়েকবার ঘটে, তাহলে রাশিগুলোরযোগফলকে ঘটনা সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে গড় সংখ্যাটি পাওয়া যায়। ধরি, তামিমের১৫৩ রান এসেছে তিনটি ম্যাচ থেকে। তাহলে এই তিন ম্যাচে তামিমের গড় রান হবে১৫৩ ÷ ৩ = ৫১।
গড়ের ধারণায় কিন্তু একটি বড় ফাঁক আছে, যা আমরা অনেক সময় মনে রাখি না। অন্যযেকোনোভাবে ১৫৩ রান করলেই তামিমের গড় রান ৫১-ই হতো। যেমন যদি তামিম একম্যাচে ১৫৩ রান আর বাকি দুই ম্যাচে কোনো রান না করে তাহলেও তার রানের গড়হতো ওই ৫১-ই।
আবার গড় করার সময় একই জাতীয় রাশির কথা মনে রাখতে হয়। তেমনটি বিবেচনা নাকরলে কী হয় তার একটি অভিজ্ঞতা আমার আছে। চাচা ঈশ্বরদীতে থাকার সময় তাঁরবাড়িতে এক গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। চাচি প্রতিদিন গাছ থেকে আমপাড়িয়ে তা বাজারে বিক্রি করতে পাঠাতেন বশির মিয়াকে। বশির মিয়া একটি ঝুঁড়িতে৬০টি পাকা আম আর একটি ঝুঁড়িতে ৬০টি কাঁচা আম নিয়ে বাজারে যেত। বশির মিয়াপ্রতি জোড়া পাকা আম পাঁচ টাকা আর কাঁচা আম পাঁচ টাকায় তিনটি বিক্রি করত।এভাবে প্রতিদিনই বশির মিয়া আম বিক্রি করত।
একদিন বশির মিয়া চাচার সঙ্গে চলে গেল অফিসে। আমি ভাবলাম, বিক্রির কাজটা আমিকরি। চাচিও সায় দিলেন। বললেন, তোমার আলাদা করে বিক্রি করার দরকার নেই।তুমি হরেদরে পাঁচটা ১০ টাকা করে বিক্রি করে এসো।
আমার তো প্রবল উৎসাহ। নিজেই ঝাঁকা নিয়ে বাজারে গেলাম এবং দুপুরের মধ্যে ১০টাকায় পাঁচটা করে সব আম বিক্রি করে বাসায় ফেরত এলাম। বাসায় ফিরে সব টাকাচাচিকে দিলাম।
চাচি টাকা গুনে বললেন, ‘আর টাকা আছে?’
-‘না, নেই।’
-‘কেন? এখানে তো ২৪০ টাকা। আর বশির মিয়া তো আমাকে প্রতিদিন ২৫০ টাকা দেয়। বাকি ১০ টাকা?’
সেদিন চাচিকে বোঝাতে আমার প্রাণ যায় অবস্থা। কিন্তু রাতে চাচা এসে সবপরিষ্কার করে দিলেন। চাচা চাচিকে বললেন, ‘বশির মিয়া সব আম বিক্রি করে ২৫০টাকা পায় আর আমার ভাতিজা সব আম বিক্রি করে পেয়েছে ২৪০ টাকা।’ এটা সম্ভবহয়েছে ‘হরেদরে’ বা গড় করার কারণে। বশির মিয়া ৬০টি পাকা আম প্রতি জোড়া পাঁচটাকা হিসাবে ১৫০ টাকায় আর ৬০টি কাঁচা আম প্রতি তিনটি ১০ টাকা হিসাবে ১০০টাকায় অর্থাৎ মোট ২৫০ টাকায় সব আম বিক্রি করে। আমি যেহেতু হরেদরে বিক্রিকরেছি, তাই ১২০টি আম (১২০ ÷ ৫ = ২৪×১০) = ২৪০ টাকায় বিক্রি করেছি। বশিরমিয়ার কাঁচা আম আর পাকা আম সমান সমান। কিন্তু, বিক্রির দাম সমান নয়। আমি গড়করাতে প্রথম দিকে পাঁচটি আমে দুইটি পাকা আর তিনটি কাঁচা আম দিতে পারলেওএকসময় কাঁচা আম সব শেষ হয়ে যায়। কিন্তু পাকা আম অনেক থেকে যায়। তখন পাঁচটিপাকা আম ১০ টাকায় বিক্রি করেছি, অর্থাৎ আগের চেয়ে কম দামে! ফলে আমার মোটবিক্রির টাকা কমে গেছে। এই হচ্ছে গড়ের মাহাত্ম্য!
আরও একটি সমস্যার কথা ভাবা যায়। একবার ময়মনসিংহ গণিত উৎসবে যাওয়ার সময় আমরাহিসাব করে দেখলাম, যদি গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার হয়, তাহলে আমরাসেখানে পৌঁছাব সকাল নয়টায়। আর যদি গাড়ি আস্তে আস্তে অর্থাৎ ২০ কিলোমিটারগতিতে চলে তাহলে পৌঁছাব বেলা ১১টায়। তো ঝটপট আমরা ভাবলাম ৩০ আর ২০-এর গড়অর্থাৎ ২৫ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চললে আমরা ১০টায় পৌঁছাব। তাই না?
মোটেই না!
কারণ, এখানে আমরা একটি জটিল হিসাব করছি। যাত্রার সময় নির্ভর করে পথেরদূরত্বের ওপর। আমাদের যাত্রার স্থান থেকে ময়মনসিংহের দূরত্ব জানা থাকলেহিসাব করাটা সহজ হতো। কিন্তু এখন একটু ভিন্নভাবে করা দরকার। আমাদের গাড়ি ৩০কিলোমিটার গতিতে বেলা ১১টা পর্যন্ত চললে আমরা ময়মনসিংহ ছাড়িয়ে আরও ৬০কিলোমিটার চলে যেতাম। অন্যদিকে একই সময়ে ২০ কিলোমিটার বেগে চললে বেলা ১১টায়সময় আমরা ময়মনসিংহে থাকতাম। এর মানে ৩০ কিলোমিটার আর ২০ কিলোমিটার বেগেবেলা ১১টা পর্যন্ত চললে ব্যবধান হতো ৬০ কিলোমিটার। এখন ৩০ কিলোমিটার আর ২০কিলোমিটার বেগে ঘণ্টার ব্যবধান হয় ৩০-২০ = ১০ কিলোমিটার।
সে ক্ষেত্রে ৬০ কিলোমিটার ব্যবধানের সময় লেগেছে ৬০ ÷ ১০ = ৬ ঘণ্টা!
অর্থাৎ ২০ কিলোমিটার বেগে ছয় ঘণ্টা চলাতেই ৬০ কিলোমিটার ব্যবধান হয়েছে। এইছয় ঘণ্টায় পাড়ি দেওয়া পথই ময়মনসিংহের দূরত্ব = ৬×২০ = ১২০ কিলোমিটার। এখন১১টার বদলে যদি ১০টায় ময়মনসিংহে পৌঁছাতে চাই তাহলে এই ১২০ কিলোমিটার পথআমাদের পাড়ি দিতে হবে পাঁচ ঘণ্টায়। সে ক্ষেত্রে গাড়ির গড়বেগ হতে হবে ১২০ ÷ ৫ = ২৪ কিলোমিটার!!
বোঝাই যাচ্ছে, গড়ের মাঠে গড়াগড়ি খেতে চাইলে সতর্ক থাকতে হবে নানা বিষয়ে।
এখন বের করার চেষ্টা করো—বাসা থেকে বৈশাখী মেলায় যাওয়ার সময় তোমার গতিবেগছিল ঘণ্টায় ছয় কিলোমিটার আর ফেরার পথে (তখন ক্লান্ত) তোমার গতি ছিল ঘণ্টায়আট কিলোমিটার।
আসা-যাওয়ায় তোমার গড় গতিবেগ কত?

গড়পণ্ডিতের ভরাডুবি
যেকোনো বিষয়ের গড় করতে সিদ্ধহস্ত গড়পণ্ডিত একবার এক খালের পাড়ে এসে দাঁড়ান।জানতে পারেন পাড়ের দিকে খালের গভীরতা দুই ফুট কিন্তু মধ্যে আট ফুট। তিনিহিসাব করে বের করলেন খালের গড় গভীরতা পাঁচ ফুট। নিজে যেহেতু ছয় ফুট লম্বা, তাই তিনি বুঝলেন এই খাল তিনি হেঁটে পার হতে পারবেন। এই ভেবে তিনি হাঁটতেশুরু করেন এবং মাঝখানে গিয়ে তাঁর সলিল সমাধি হয়!!!

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version