উদ্ভাবনের কলকব্জা ২: বাক্সের বাইরে – ব্যাক টু ব্যাক লেটার অব ক্রেডিট

Spread the love

আগের পর্ব – উদ্ভাবনের কলকব্জা-১ : উদ্ভাবন বৈষম্য

উদ্ভাবনের ব্যাপারটার সঙ্গে বাক্সের বাইরে চিন্তা করার একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়। এমনকি এই ধরনের যে ক্লাস/কর্মশালা হয় সেখানে ৯-বিন্দুর একটি সমস্যাও দেওয়া হয়। বলা হয়, কলম না তুলে মাত্র চারটি সরলরেখা এঁকে এই বিন্দুগুলোকে জোড়া দিতে হবে। যারা বিন্দুর মধ্যে ঘোরা ফেরা করেন তারা আসলে পথ খুঁজে পান না। ওনাদেরকে তখন দেখানো হয় এই সমস্যার সমাধান করতে হলে বাক্সের বাইরে যেতে হয়। যে বিষয়টা উহ্য থাকে, বলা হয় না, সেটা হল বাক্সেই কিন্তু ফিরতে হয়। না হলে প্রথম ধাপটা অর্জন হয় না।

 

আমাদের দেশে সবকিছু বলে দিতে হয়। না হলে ব্যাপারটা সেই ট্রাক ড্রাইভারের মত হতে পারে।
এক্সিডেন্টের পর জ্ঞান ফিরে আমাদের ড্রাইভার আনোয়ার হোসেন ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এই ভাবে- রাস্তা দিয়ে যাইতে আছি। দেখলাম একটা গাড়ি আইতেছে উল্টা দিক দিয়ে। ওস্তাদের কথা মনে পড়লো। ওটারে সাইড দিলাম। একটু পর দেখি একটা বাস আইতে আছে। হেডারেও সাইড দিলাম। ওস্তাদ কইছে রাস্তায় সবাইরে সাইড দিয়া দিবি। তো, তারপর দেখি একটা ব্রিজ আমার দিকে আইতে আছে। আমি সেটারেওভি সাইড দিয়া দিলাম।”
এই গল্পটা আমাদের হুজুগের ব্যাপারটাকেও অনেকখানি সামনে নিয়ে আসে।গত ক’দিন ধরে উদ্ভাবনী কলকব্জা নিয়ে আমি কিছু পড়াশোনা করার চেষ্টা করছি। যাকে বলি সেই দেখি এখন একটা এপের কথা বলে। যেনবা সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে একটা এপ বানানো!! অথবা কেমন করে ফেসবুক বা ইন্টারনেটকে ব্যবহার করা যায়। অথচ আমাদের সব সমস্যার সমাধান কিন্তু ইন্টারনেটে নাই।

আমাদের বাক্সের বাইরেও ভাবতে হবে।
আমি ভাবছি চিন্তাটাকে খোলাসা করা জন্য বিভিন্ন ইনোভেশনের গল্পগুলো জানা হোক। সেটা আইটি এবং আইটির বাইরেও। এবং সেটা শুরু হতে পারে আমাদের শতভাগ রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস শিল্পের জনক, মুক্তিযোদ্ধা নুরুল কাদেরের উদ্ভাবন ব্যাক টু ব্যাক এলসি দিয়ে।

নুরুল কাদের (১৯৩৫-১৯৯৮)

নুরুল কাদের দেশ গার্মেন্টসের মালিক হিসাবে পরিচিত। তাঁর সম্পর্কে দুইটি কথা বলে রাখা ভাল তাহলে ব্যাপারটা হয়তো ধরতে সুবিধা হবে। ৬ ভাইবোনের মধ্যে নুরুল কাদের সবার ছোট। ১৯৭০ সালে তিনি পাবনার জেলা প্রশাসক ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কয়েকদিন পাবনাকে মুক্ত রেখেছিলেন এবং চালু করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সরকারের সচিব এবং যুদ্ধের পর প্রথম সংস্থাপন সচিব হোন। তাঁর হাত দিয়ে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন।
পরে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিভৃতে চলে যান। সেই সময়ের অনেকখানি দেশের বাইরে কাটিয়েছেন। ১৯৭৫ সালে স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসেন।
১৯৭৬ সালের বাংলাদেশটাকে আমরা প্রথমে দেখি। স্বাধীনতার স্থপতিকে মেরে ফেলা হয়েছে। জনমুখী কর্মকাণ্ডের বারোটা বাজিয়ে নানান ধরণের প্যাচ ট্যাচ শুরু হয়েছে দেশে। শিল্পায়নের কোন খবর নাই। থাকার কোন কারণও নাই।
স্বাধীনতার আগে আমাদের শিল্পায়ন বলতে পাটকলগুলো। আদমজী তখন এশিয়ার সবচেয়ে বড় পাটকল। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে কয়েকটি ছোট ছোট বস্ত্রকল গড়ে উঠেছে। যুদ্ধের পর আমাদের পাটকলগুলো জাতীয়করণ করা হয়েছে। তবে, বিপ্লবের পর অন্যান্য দেশে যা করেছে সেই কাজটা না করে মানে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দেশটাকে না দিয়ে পাকিস্তান ফেরৎ লোকজনের হাতে এগুলো চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে অচিরেই এগুলো লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এই পরিণতি দেখে কেও তেমন একটা কিছু করার কথা ভাবেনি। ব্যবসা বলতে ইন্ডেন্টিং আর ট্রেডিং।
১৯৭৬ সালে নুরুল কাদেরও তাই শুরু করলেন। আমেরিকার ইউনিয়ন ওয়েল কোম্পানি, সুইজারল্যান্ডের ভাললার এজি, জেনারেল মোটর, ক্যাম্পোটেক্সের ইন্ডেন্ট দেওয়া শুরু করলেন। আর ভাবতে শুরু করলেন নতুন কিছু করা যায় কি না। তার চিন্তার একটা অংশ জুড়ে থাকতো মেয়েদের কথা, নারীর কাজ।

কেন?

নুরুল কাদের নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন। ৬ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট কাদেরের বড় তিন বোন ছিল। ছোট বেলায় কাদের আপাদের পেছনে ঘুরে ঘুরে সময় কাটাতো। তারা সবাই শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী ও স্বাধীন। এদের মধ্যে ছোটজনের কাছে কাদের শিখেছে কেমন করে রান্না করতে হয়, সেলাই করতে হয় কিংবা বাঁজাতে হয় সেতার। মায়ের সঙ্গে বোনদের নিয়ে কাদের তাঁর পরিবারের মেয়েদের কথা বলতো -“ফুল অব উইজডম”। কাজে মহিলাদের ব্যাপারে কাদেরের খুব গভীর শ্রদ্ধা ছিল। সেলাই ফোঁড়াই-এর ব্যাপারটাও মাথায় ছিল।
সে সময় কোরিয়ান দাইয়ু কোম্পানির চেয়ারম্যান কিম উ চং-এর সঙ্গে তার দেখা, পরিচয় এবং আলাপ হয়। কোরিয়ানদের তখন মাথায় বাড়ি। মার্কিন মুলুকের সেই সময়কার বিধাতা পুরুষ রিচার্ড নিক্সন এমএফএ নামে একটা জিনিস করেছেন। যার ফলে কোরিয়ার মত দেশগুলো আমেরিকাতে গার্মেন্টস পন্য রপ্তানীতে কোটার সম্মুখীন হয়। দাইয়ুর চেয়ারম্যান তাই খুঁজছিলেন এমন কোন দেশ যেখানে এখনো শার্ট তৈরি একটা শিল্প হয়ে ওঠেনি।
১৮৭৮ সালে বাংলাদেশে রপ্তানী করে এমন মোট নয়টি গার্মেন্টস ইউনিট ছিল। এগুলোর মিলিত রপ্তানীর পরিমাণ ছিল বছরে ১০ লক্ষ ডলারেরও কম। এগুলোর বেশিরভাগই খুব ছোট এবং তারা দেশের জন্যও গার্মেন্টস বানাতো। সেই রকমই একটা হল ৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত রিয়াজ গার্মেন্টস। রিয়াজ স্টোরের টেইলারিং শাখা হিসাবেই সেটির জন্ম। ১৫ বছর ধরে এই কাজ করার পর, স্বাধীনতার পর, এটি স্বতন্ত্র ইউনিট হিসাবে যাত্রা শুরু করে । নাম দেওয়া হয় রিয়াজ গার্মেন্টস লিমিটেড। ১৯৭৮ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস পুরুষদের ১০ হাজার পিস শার্ট রপ্তানি করে প্যারিসের একটি প্রতিষ্ঠানে। আয় হল ১ কোটি ৩০ লক্ষ ফ্র্যান্ক।
এরকম পরিস্থিতিতে কিম উয়ু চঙ্গের প্রস্তাব বিবেচনা করে নুরুল কাদের একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার করার কথা ভাবলেন। ঠিক হল শতভাগ রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস গড়া হবে। ১৯৭৮ সালের ৪ জুলাই নুরুল কাদেরের সঙ্গে দাইয়ু কর্পোরেশনের ঐতিহাসিক চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়। ঠিক হল নুরুল কাদের করবেন সকল আর্থিক বিনিয়োগ আর দাইয়ু দেবে জ্ঞান-সহায়তা।

চুক্তি স্বাক্ষর করলে কী হবে? লোক পাবে কই?

১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসের দুই তারিখ। সকাল থেকেই মধুর কেন্টিনে ব্যপক উত্তেজনা। কারণ স্বাধীনতার পর আর কোন রিক্রুটমেন্ট কাজে এত বড় বিজ্ঞাপন ছাপা হয়নি। আধাপৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা হয়েছে এমন এক চাকরির খবর যা আগে কেও কখনো ভাবেনি। তরুনদের বেশিরভাগই আনন্দিত, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তও বটে। তবে, অনেকেই হামলে পড়ে সব নোট নিতে শুরু করেছে নতুন এক সম্ভাবনার। বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে দেশ গার্মেন্টেসের। চাহিদা ১৩০ জন তরুন-তরুনী যারা ছয় মাসের জন্য চলে যাবেন দক্ষিণ কোরিয়ার পুষন শহরে। সেখানে দাইয়ুর কারখানায় শিখতে হবে শার্ট বানানোর কাজ।
ঐ ১৩০ জন ছয়মাস পরে ফিরল দেশে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে গড়ে উঠলো দেশ গার্মেন্টস। ৬ লাইন, ৬০০ কর্মী আর বছরে ৫০ লক্ষ পিস শার্ট তৈরির সক্ষমতা। তের লক্ষ ডলারোর মোট বিনিয়োগ। এক লক্ষ ২০ হাজার পিস শার্ট জার্মানীর এমএনআর কোম্পানির কাছে রপ্তানী করে দেশ শুরু করলো তার শার্ট রপ্তানীর ব্যবসা।

কারখানায় কাজ দেখছেন নুরুল কাদের

১৯৮১-৮২ সালে দেশ গার্মেন্টসকে ১৮ কোটি টাকার রপ্তানী করার অনুমোদন দেওয়া হল। কিন্তু সিসিআইএন্ডই (CCI&E) দেশ গার্মেন্টসকে কাঁচামাল আমাদানী করার অনুমতি দিল মাত্র ২৪ লক্ষ টাকার! মানে ১.৫%। পুরো ফ্যাক্টরি অলস বসে থাকলো।
চিন্তিত নুরুল কাদের ভাবেন। পকেটে ১৮ কোটি টাকার অর্ডার কিন্তু সাপ্লাই দেওয়ার উপায় নাই। রসদের জন্য ব্যাংক টাকা দিবে না, ২৪ লাখ শেষ। কিছু একটা ভাবলেন কয়েকরাত। কাগজে আঁকিবুকি করলেন। তারপর সকালে ওঠে গেলেন বাংলাদেশ ব্যাংকে।
নুরুল ইসলাম সাহেব তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। সব শুনে বললেন – আপনার প্রস্তাব কী?
-তেমন কিছু না। ব্যাংক আমাকে ৯০-১২০ দিনের ডেফার্ড পেমেন্ট এলসি খুলতে দিক। সিকিউরিটি হিসাবে আমার অর্ডারের এলসিটা রেখে দিক। আমি তাহলে কাপড় এনে শার্টট বানিয়ে সেটি সাপ্লাই দিতে পারবো। এবং সাপ্লাই-এর বিল থেকে ব্যাংকের টাকাটা দিয়ে দিতে পারবো। একটা ত্রিপক্ষীয় বিশ্বাসের কর্মকাণ্ড।
গভর্নর আর নুরুল কাদের অনেক আলাপ করলেন। নানান দিক ভাবলেন। তারপর নুরুল ইসলাম সাহেব কাদেরকে বললেন- আপনার প্রস্তাবটা লিখিত আকারে জমা দিন।
গভর্নর সাহেব নিজেই দৌড়ঝাপ করলেন এবং চালু হয়ে গেল ব্যাক-টু-ব্যাক লেটার অব ক্রেডিট ব্যাংকিং সিস্টেম। গার্মেন্টসের কাপড়, বুতাম আনার জন্য যে হেভি ক্যাশের দরকার ছিল সে সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।
আর আমরা দেখে ফেললাম নুরুল কাদের দ্যা গ্রেটের সবচেয়ে যুগান্তকারী উদ্ভাবনটি।
ব্যাক-টু-ব্যাক এল সি। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের প্রাণ ভোমড়া।

এখন আমরা ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির একটা ময়না তদন্ত করে দেখতে পারি।
সমস্যা : প্রোডাকশনের জন্য রসদ দরকার। রসদ দেশে নাই, আমদানী করতে হবে। আমদানী করার জন্য টাকা দরকার অথবা ক্রেডিট দরকার। নিজের কাছে টাকা নাই। তাহলে ক্রেডিট চাইতে হবে ব্যাংকের কাছে। ব্যাংক এলসি খুলতে পারে কিন্তু কিসের বিপরীতে খুলবে। মাজিন কী হবে?
হাতের পাঁচ : বায়ারের এলসি পকেটে নিয়ে বসে আছি। এটা দিয়ে কিছু করা যায়?
সমাধান : বায়ারের এলসিটা জমা রেখে ব্যাংক আমার রসদের জন্য এলসি খুলে দিক।

খুবই সহজ। তাই না?

জয় বাংলা।

পরের পর্ব- উদ্ভাবনের কলকব্জা ৩: দেখতে হবে আশে পাশে

 

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version