উদ্ভাবনের কলকব্জা -১: উদ্ভাবন বৈষম্য???

Spread the love

ইনোভেশন ডিভাইড, নতুন শব্দ তবে কাজে নতুন নয়।

কখনো কী আমরা ভেবেছি গুগল, ফেসবুক কেন আমেরিকাতে শুরু হয়, জাপানীরা কেন নতুন গাড়ি বানায়, কোরিয়ানদের হাতে কেন স্মার্টফোনের কলকব্জা।

প্রশ্নটা জটিল কিন্তু দরকারী। কারণ আমরা বলতে শুরু করেছি পরের ফেসবুক গুগল আমরাই বানাবো। কিন্তু তার জন্য প্রস্তুতি কি নিচ্ছি?
প্রথমে প্রথম প্রশ্নের উত্তর খোজা যাক। একটা জাতি উদ্ভাবনী হবে কী না সেটা কিসের ওপর নির্ভর করে?
একটা সহজ উত্তর, এই একুশ শতকে, হল জ্ঞান। যে জাতি জ্ঞানে বিজ্ঞানে উন্নত তাদের উদ্ভাবন বেশি। এবং এটা আবার তাদের ফীডব্যাক করে ফলে তারা আরো এগিয়ে যায়।  মানে যারা ভাল তারা আরো ভাল হয়। তেলা মাথাতে তেল দেওয়া আরকি। তারপর তারা আরো একটা কাজ করে সেটা হল সারাবিশ্বের মেধাবী লোকগুলোকে নিজের দেশে ধরে বেঁধে নিয়ে আসে। ফলে, সেরা মেরিটগুলো পেয়ে যায়।
এই জন্য তারা ভাল একটা ইকো সিস্টেম তৈরি করেছে। সেটি নানান বাঁধা অতিক্রম করে। আরবের তোল-শেখরা ১৯৭২-৭৩ সালে একবার আমেরিকাকে তুর্কী নাচন নাচিয়েছিল। তারপর থেকে তারা নানান ভাবে জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকার চেষ্টা করে। রোনাল্ড রিগ্যান সাহেব তার আমলে ঘোষণা করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক যদি কিছু বানান তাহলে সেটার মেধাস্বত্ত্ব তাঁর হবে, পাবলিকের হবে না। এবং এর পরেই একটা ইনোভেশন বুম হয়েছে আমেরিকাতে। ওদের আরো নানান উপযোগিতা আছে।
কোরিয়ানরাও একই রাস্তা ধরেছে। ওখানে প্রফেসরদের বেতন-বোনাস ঠিক হয় তাদের গবেষণা, সাইটেশন এসব দিয়ে। লাল-নীল রং দিয়ে নয়। আমাদের এখানে কোন শিক্ষক যদি মোটামুটি একটু গবেষণাবাতিকগ্রস্ত হয় তাহলে তার কপালে জোটে নানান তকমা এবং উনি যাতে টাকা পয়সা না পান সেটা কনফার্ম করা হয়।
একটা ইনডেক্স আছে, গ্লোবাল ইনোভেশ ইনডেক্স। সেখানে আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। এবং সেটা নিচের দিকে। ভাবা যায়? আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, কুদরাত-ই-খুদা, মাকসুদুল আলমের দেশে নাকি উদ্ভাবন হয় না?
আসলেই কী হয় না? আমাদের কী গ্রামীণ ফোন আর বিকাশের মত উদ্ভাবন নাই? আছে। তবে, অন্য সবক্ষেত্রের মত এখানেও আমাদের সম্পূর্ণতা নেই। অন্যান্য দেশে, মানে যেগুলো উদ্ভাবনে আগানো তারা উদ্ভাবনের সাইকেলটা সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করে। আমরা করি না। কারণ আমাদের অনেক তাড়া থাকে।

উদ্ভাবনের সাইকেলটা কী। এটা সহজ – সমস্যা খুঁজে পাওয়া – সেটির সমাধান সম্পর্কে একটি হাইপোথিসিস দাড় করানো- সেটাকে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে সফল বা ব্যর্থ হওয়া – ব্যর্থ হলে ব্যর্থতার কারণ বের করে সেটি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া – সফল হলে সেটার ডকুমেন্টেশন করা- সেটি সবার সঙ্গে শেয়ার করা (জার্নালে প্রকাশ করা ইত্যাদি)- এটির বানিজ্যিক রূপ দেওয়া – বাণিজ্যের জন্য সহায়ক পরিস্থিতি না থাকলে সেটা তৈরি করা —

তো, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামও তাদের ইনডেক্স বানানোর সময় সেটা খেয়াল রাখে। ওখানে ইনপুট হিসাবে বিবেচিত হয় – ১. প্রতিষ্ঠান, ২. মানব সম্পদ ও গবেষণা, ৩. অবকাঠামো, ৪. বাজারের বিশুদ্ধতা, ৫. ব্যবসার সহজতা। আর যে দুইটি মাপকাঠিতে উদ্ভাবননের আ্কউটপুট মাপা যায় তা হল – জ্ঞান ও প্রযুক্তির আউটপুট এবং সৃজনশীল আউটপুট।

এখন আমরা যদি কয়েকটা বিষয়ে কাজ করতে পারি তাহলে আমরা উদ্ভাবনী জাতি হিসাবে আমাদের হৃতগৌরব ফিরে পেতে পারি-

ক. প্রশ্ন-উত্তরের বেড়াজাল থেকে শিক্ষাকে প্রবলেম সলভিং-এ উন্নীত করা,

খ. মুখস্ত প্রবণতা থেকে জাতিকে বের করা

গ. সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দেওয়া।

ঘ. আয়ই উন্নয়ন এই ধারণাকে জোরদার করা।

ঙ. বিনিময়েই জ্ঞানের শক্তি (শেয়ারিং নলেজ ইজ পাওয়ার) এই ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়া।

একটা মজার বিষয় হল তথ্যপ্রযুক্তি কিন্তু এখন এই সমীকরণকে অনেক সহজ করে ফেলেছে। আমি কয়েকটা উদাহরণ আমার বক্তৃতায় দেই। যেমন এই ৪৩ বছরে আমাদের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ হল ২২ বিলিয়ন ডলার আর হোয়াটসএপ বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৯ বিলিয়ন ডলারে। এংরি বার্ডের দাম মাত্র ৮০ মিলিয়ন ডলার। এবং বিশ্বের প্রধান প্রধান ধনকুবেরদের সামনের সারিতে তথ্যপ্রযুক্তির কাণ্ডারিরা বসে আছে।

চেষ্টা করলেই একটা জাতি কিন্তু ডিজিটাল ডিভাইড কমাতে পারে সহজে। কারণ এর মূলে আছে একসেসের অভাব। দুটোই আসলে অবকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত এবং এটাকে জয় করা যায়। বাংলাদেশের মত দেশেও ৯৮ ভাগ লোক মোবাইল আর ইন্টারনেটের আওতায় আছে। কিন্তু তারা সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করে না। কারণ তারা জানে না কেন তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করবে। কিংবা ইন্টারনেট এখনো আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়নি।
কিন্তু গোড়া থেকে চেষ্টা না করলে এবং গভীরে ঢুকে চেষ্টা না করলে একটা জাতিকে ইনোভেশনের ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়।

আমি এখনো ঠিক পরিস্কার নই, কেমন করে আমাদের এই সৃজনশীলতা আর উদ্ভাবনের ব্যাপারটাকে ইতিহাস থেকে বর্তমানে পূর্ণদ্যমে ফিরিয়ে আনা যাবে। তবে, কাজটা যে মোটেই অসম্ভব নয় সেটা জানি। আমাদের নানান আয়োজন যেমন গণিত বা পদার্থবিজ্ঞানের অলিম্পিয়াড, সায়েন্স কার্নিভাল বা কংগ্রেস এমনকী হালের হাইস্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা – এসবই শেষ পর্যন্ত সৃজনশীলতার সহায়ক।
এখন হয়তো এগুলো যে ভিত্তি গড়ে দিচ্ছে সেটাকে আরো বড় পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়ার পালা।
কাজ করতে হবে  হবে সবাইকে, একত্রে এবং আলাদাভাবে। কাজটাই আসল। কে করলো তা নয়।

সবার জন্য শুভ কামনা।

পরের পর্ব –উদ্ভাবনের কলকব্জা ২: বাক্সের বাইরে – ব্যাক টু ব্যাক লেটার অব ক্রেডিট

 

2 Replies to “উদ্ভাবনের কলকব্জা -১: উদ্ভাবন বৈষম্য???”

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version