প্রয়োজনের পেছনে নয়, স্বপ্নের পেছনে দৌড়াও

Spread the love

বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারে (এখন যেটা আইআইসিটি) চাকরি করার সময় আমার একবারের বস ছিলেন প্রফেসর আলী মূর্ত্তাজা স্যার (পরে বুয়েটের ভিসি হয়েছেন, শহীদ আসাদের ভগ্নিপতি)। স্যার আলী লিখেন ডাবল ই দিয়ে!  স্যারের কাছ থেকে আমি অনেক অনেক কিছু শিখেছি। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, সফলতার পাঠ চাইলে স্যারের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করা দরকার।

স্যার যখন আমাদের সেন্টারে জয়েন করেন তখন আগের পরিচালক মুজিবুর রহমান স্যার তাঁকে আইবিএম মেইনফ্রেম কম্পিউটারের মেইনটেইন্যান্সের একসেস দিয়ে যান। আমি যেহেতু প্রোগ্রামারদের মধ্যে সিনিয়র কাছে আমি ভেবেছি কাজটা আমি পাবো, কারণ স্যার তো সিভিলের। এর মধ্যে আমরা কিন্তু শুনেছি, হেলাল ভাই-এর কাছ থেকে, যে এটা ম্যানেজ করতে ৭ ফুট বই পড়তে হয়।

স্যার আমাকে ডেকে বললেন, বইপত্র কী আছে নিয়ে আসো। আগে আমি মেইনটেইন্যান্স শিখবো, করবো, তারপর তোমাকে দিব।
স্যার ঠিক ঠিক তাই করলেন। মোটামোটা বইগুলো পড়ে দিব্যি একটা জটিল সিস্টেম চালানো শুরু করলেন। স্যারের সময় আমরা কেবল একবার একটা সমস্যায় পড়েছিলাম। সেটা হল ডিরেক্টরি সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়া। আমার আর স্যারের তিন দিন লাগে এটা সচল করতে! (এটা চালু করতে maint এর একাউন্টে কেবল লিখতে হয়েছে dirm on) 😀 ।

আইবিএমের ৪৩৩১ মেইন ফ্রেমের অপারেটিং সিস্টেম ছিল VM/CMS। মানে রিসোর্স মেইনটেইন্যান্স সিপির হাতে। আর টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেম ভিএম। স্যার দিব্যি কাজটা করলেন। কয়েকমাস পরে, আমাকে ডাকলেন। সব বই দিলেন। আমি দেখলাম বই-গুলোর মধ্যে মাঝে মাঝে মার্ক করা আছে।
“তোমার আর ৭ ফুট বই পড়তে হবে না। মার্ক করা জায়গাগুলো দেখলে হবে। আর আটকে গেলে আমি তো আছি।–

স্যার আমাকে সিস্টেমর দায়িত্ব দিলেন।

তো, স্যার এই কাজটা কেন করেছিলেন। কারণ স্যার বিশ্বাস করতেন – এই পৃথিবীতে কেও অপরিহার্য নয়। কবরস্থানে অনেক অপরিহার্য লোক শুয়ে আছে। এর সহজ অর্থ দাড়ায় যে কেও যে কোন কাজই করতে পারে।

স্যারের কাছ থেকে এটা আমি শিখেছি। হৃদয়ের গভীরে নিয়েছি। কাজেই আমি আমার নিজের কাছে, আমার অজস্র দোকানের কোনটারই চাবি রাখি না। সব নানান জনকে দেওয়া আছে। আল্লাহ ডাক দিলে যেন তৎক্ষনাৎ চলে যেতে পারি। আমাদের দোকানগুলো ইনশাআল্লাহ চলতে থাকবে।

স্যারের কাছ থেকে আমার দ্বিতীয় শেখাটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একদিন সকালে স্যার ডেকে বললেন – মাসে যে টাকা পাও, তাতে কী চলে?

আমি বললাম – স্যার, সামান্য কিছু বেশি হলে আরো কমফোর্ট হতো।

  • ও, আচ্ছা।

স্যার কী বুঝলেন জানি না। তবে, দেখলাম আমাকে কিছু কনসালটেন্সি কাজ বেশি দেওয়া হল। আমিও কিছু টাকা বেশি কামালাম।

আর একদিন – কী মিয়া, এখন কী খবর।

  • ভাল স্যার। আর একটু বেশি হলে ভাল হতো স্যার।

-হুম, এটাই কথা। এটা একটা নেভার এন্ডিং স্টোরি। তুমি যতো পাবা, আরো বেশি পেতে চাইবা এবং তোমার চাওয়া কখনো শেষ হবে না। কারণ তোমার প্রয়োজন কখনো ফুরাবে না। তুমি যদি প্রয়োজনের পেছনে না দৌড়াও তাহলে তুমি ভাল থাকবা।

প্রথম প্রথম স্যারের কথাতে মন খারাপ হয়েছিল। কারণ ততোদিনে আল্লাহ আমাকে কয়েকটা বিশেষ দক্ষতা দিয়েছেন কাজে। সেগুলো কাজে লাগিয়ে সন্ধ্যাবেলায় কনসালটেন্সি করে অনেক টাকা কামানোর রাস্তা খুলে গেছে। আমি ঝাঁপ দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। কিন্তু এ সময় স্যার এগুলো কী বললেন।

কিন্তু, আগে থেকে স্যারের প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস থাকায় ভাবলাম স্যারের কথাগুলোর কোন অর্থ আছে কী না বোঝা যাক।

সন্ধ্যাবেলার কনসালটেন্সির প্রস্তাব নাকচ করে গণিত অলিম্পিয়াডের পেছনে ছুটতে শুরু করলাম। আমার কনসালটেন্সি লাটে উঠলো।

২০০৪ সালের জুলাই মাসে এথেন্স যাবো, গণিত অলিম্পিয়াডের বিশ্ব আসরে। মোটামুটি ১৩-১৪ দিনের ঝামেলা। স্যার তখন বুয়েটের ভিসি। গেলাম স্যারের কাছে।

  • কী মুনির। ১৩-১৪ দিন যদি এই ফাও কামে যাও তাহলে তো টাকা কামাইতে পারবা না। আর ১৫ দিন ছুটির ১৩ দিনই তো এখানে চলে যাবে।

স্যার কে জানালাম আমি এখন আর প্রয়োজনের পেছনে দৌড়াই না। নিজের স্বপ্ন নিয়েই থাকি।

স্যার দরখাস্ত হাতে নিয়ে বললেন – তুমি তো এখন সিনিয়র হয়ে গেছ। তোমার ছুটির দরখাস্ত তো সচিবালয়ে পাঠাতে হবে।
আমি বললাম, স্যার তাইলে আর আমার যাওয়া হবে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা চাইলে কয়েকটা ক্ষেত্রে নিজেরাই এক্স-বাংলাদেশ ছুটি দিতে পারেন। স্যার আমার জন্য তাই করলেন।
এথেন্স থেকে ফেরার দুই সপ্তাহ পর আমি বুয়েট থেকে ছুটি নিয়ে বের হয়ে আসি। পরে আর কখনো সেখানে ফেরৎ যাওয়া হয়নি।

আজ অনায়াসে আমি বলতে পারি। স্বপ্ন পূরণ হোক বা না হোক, ওতে যে আনন্দ, সেটা টাকা বা অন্য কিছুর পেছনে দৌড়ালে পাওয়া যায় না।

প্রয়োজনের পেছনে নয়, স্বপ্নের পেছনে দৌড়াও

সবার জীবন পাই এর মত সুন্দর হোক।

One Reply to “প্রয়োজনের পেছনে নয়, স্বপ্নের পেছনে দৌড়াও”

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version