আমার জীবনের লক্ষ্য?

Spread the love
নতুন ভভনের সামনে। ডানদিক থেকে প্রথম আমার বন্ধু ফরহাদ।

চট্টগ্রাম মুসলিম হাই স্কুলে পড়ার সময় আমাদের একটা কাজ ছিল রাজনীতির খবর রাখা। সেটা আমরা কেন রাখতাম কে জানে? মনে হয় রাজনৈতিক উছিলায় হাফ ছুটি পাবার জন্য।  কোন উপলক্ষ আছে কী না এটা জানার জন্য প্রতিদিন সকালে পত্রিকা পড়াটা আমার অভ্যাস হয়ে যায়।

আমি ছিলাম এ সেকশনে। ক্লাশ সিক্সের ক্লাশ টিচার ছিলেন ওয়াজিউল্লা স্যার। স্যার আমার প্রিয় স্যারদের একজন। ক্লাশ নাইনে স্যার আমাদের কিছুদিন বাংলা ব্যাকরণ পড়ান। এর মধ্যে “জীবনের লক্ষ্য” রচনা নিয়ে স্যার একদিন আমাদের একটা বাড়ির কাজ দেন। কাজটা হলো “আমার জীবনের লক্ষ্য” এই শিরোনামে একটা রচনা লিখতে হবে তবে সেটা বাজারের কোন বই-এর সঙ্গে মিলতে পারবে না। তখন স্যার বললেন নিজের চারপাশে তাকাতে এবং “কেন আমি কী হতে চাই” সেটা ভেবে তারপর নিজের মতো করে লিখতে। তিনি আমাদের একমাস সময় দিলেন।
রচনা লেখার জন্য আমি আমার জীবনের লক্ষ্য খোঁজা শুরু করলাম। সেই বন্ধে আমি কিছুদিন বাড়িতে গিয়ে থেকেছি। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেটে যেতে যেতে আমি দেখেছি চারপাশে সবুজের সমারোহ। ধানের ক্ষেত।  কৃষক দিন-রাত পরিশ্রম করে ফসল তুলে বলেই আমরা খেতে পারি। আমাদের যতো জমি-জমা সবই বর্গা দেওয়া। পৌষমাসে দাদি গ্রামে গিয়ে ধানের খোঁজ খবর করতেন। এ’ কদিন আগেও আমাদের বাড়ির ধানেই আমাদের বছর চলে যেত। তো, কৃষকই হলো আমার প্রথম হিরো। কৃষকের অবদানের কথা ভেবে আমি ঠিক করলাম বড় হয়ে আমি একজন কৃষক হবো।

সেটা ভেবেই রচনা লিখবো ভাবি। তবে, অন্য কথাও মনে হয়। আন্দরকিল্লা রাজাপুকুর লেনে আমাদের বাসা থেকে মুসলিম হাইস্কুল বেশ খানিকটা দূরেই। অন্যদের সঙ্গে আমিও হেটে হেটে স্কুলে যাই। বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে নজির আহমদ চৌধুরী বাই লেনে মতিন ভাই-দের বাসার কোনায় জমায়েত। সেখানে বাকিরা আসে। তারপর আমরা মাসুদদের বাসার সামনে দিয়ে নজির আহমেদ চৌধুরী রোডে এসে পড়ি। তারপর কাটা পাহাড়ের দিকে সামনে এগিয়ে হাতের বাম দিকে পাহাড় থেকে নেমে সিনেমা প্যালেসের সামনে । প্রায়ই দিনই আমরা একটু সিনেমা প্যালেসের বড় পোস্টারের দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর সেটিকে বামে রেখে আগাতে থাকি লালদিঘী ময়দানের দিকে। পথে আবার খুরশীদ মহল। ব্রিজ হোটেলকে ডানে রেখে কোর্ট বিল্ডিং-এর মোড়ে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে রাস্তা পার হয়ে স্কুল। স্কুলের পাশেই রঙ্গম সিনেমা হল। যাদের বাসা থেকে স্কুল পর্যন্ত তিন তিনটে সিনেমা হল তাদের জন্য সিনেমাটা হয়ে যায নস্যি। কাজে সিনেমা দেখার পোকাটা মাথায় ঢুকে গেল। সিনেমা দেখার সময় একটা বিষয় আমাকে খুব ভাবাতো। আমি দেখতাম সিনেমার নায়কের দু:খে সবাই দু:খিত হয় (সে সময়ের বেশিরভাগ সিনেমায় নায়ক গরিব থাকতো), তাদের সাফল্যে সবাই খুশী হয়ে সিনেমা হলেই তালি দিয়ে দেয়। আমি ভাবতাম তাহলে আমার নায়কই হওয়া উচিৎ (তখন কি জানতাম আমি কখনো চাটগাইয়া একসেন্টের বাইরে কথা বলতে পারবো না, আমার উচ্চারণ শুনে লোকে কিছু বুঝতেই পারবে না, হাসবে)। সেভাবে আমি রচনা বই-এ খুঁজি নায়কের রচনা।

ভাবতে ভাবতে আমার মনে পড়ে কোর্ট বিল্ডিং-এর ক্যানভাসারদের কথা। আমি মাঝে মধ্যে পরীর পাহাড়ে উঠে বিভিন্ন ক্যানভাসারদের কথা শুনতাম। অবাক হয়ে দেখতাম তারা কী সব অদ্ভুত  কথা বলে। যেমন – ভাইই-এ রা, আপনাদের পকেট সাবধান রাখবেন। এখন সবাই নি:শ্বাস বন্ধ করে রাখেন। হাতের মুঠি শক্ত করে রাখেন। ইত্যাদি ইত্যাদি (এখন তো জানি কেন এটা করতো)। তারা হয় কোন মলম বিক্রি করে বা কোন ওষুধ। এবং আশ্চর্য হযে দেখতাম অনেকে প্রতিদিনই তাদের মলম কেনে। আমি ভাবতাম আরে ক্যানভাসারের কথার তো অনেক জোর। সবাইকে অনেক মুগ্ধ করে রাখে। যার লাগবেনা সেও কেনে। (তখন কি জানতাম ঐ ক্রেতারা ক্যানভাসারেরই লোক!!!)। তো, আমি ভাবি আমি তাহলে ক্যানভাসারই হই। কিন্তু পরীর পাহাড় থেকে নামলেই বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের লোকেরা অনেক টাকা গুনে। টাকা ছাড়া জীবনে কিছু্ই করা যায় না সেজন্য ব্যাংকার হলেই হবে বলে মনে হয় আমার।

এসব নিয়ে যখন ভাবি তখন প্রায়শ স্কুলের স্যারদের কথা মনে হয়। তিনদিন ধরে আমি যে অঙ্ক করতে পারি না, নুরুল ইসলাম স্যার ঐটার তাকিয়ে তার সমাধান বলে দিতে পারেন।

“তুই শার্টের হাতা গুটাইছোস কেন?” এমন ইংরেজি ট্রান্সলেশন সাদত স্যার অবলীলায় বলেন। অনেক চিন্তা করেও পদার্থবিজ্ঞানের যে সূত্রটি আমি বুঝতে পারি না, সাইদুল হক স্যার সেটা হাতে হাসতে বলে দন। আর আমরা সেগুলো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি। শুনতে শুনতে শুনতে আমার মনের চৌকাঠে উকি দেয় শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন। আমার মাও শিক্ষক। কাজে এই লাইনে আগালে ভাল হবে সেই চিন্তাই আমি করি।
কিন্তু আমার মনে পড়ে যেদিন আমার ছোট ভাই-এর জন্ম হয় সেদিন প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। মাকে হাসপাতালে নেওয়া যায়নি (অথবা নেওয়া হয়নি)। কিন্তু ডাক্তার বাসায় এসে আমাদের ছোট ভাইকে দুনিয়াতে নিয়ে আসলেন। তখন থেকে আমার একটু একটু ইচ্ছা আমি আমি ডাক্তার হই। আমার দাদাও চান আমি ডাক্তার হই।

এভাবে টানাপড়েন নিয়ে আমার ছুটি শেষ হয়ে যায়। আমি আমার জীবনের সব লক্ষ্যের কথা, কৃষক থেকে ডাক্তারের কথা লিখে স্কুলে ওয়াজিউল্লাহ স্যারের কাছে নিয়ে গেলাম। স্যার বললেন – সব ঠিক আছে। কিন্তু উপসংহারে তো একটা কিছু লিখতে হবে। না হলে তো রচনা হবে না!
আমি বললাম – স্যার, আমার তো সবই ভাল লাগে। সবই আমি হতে চাই। তাহলে কী লিখবো।
স্যার আমাকে নতুন কাজ দিলেন। কৃষক, ক্যানভাসার, ব্যাংকার বা ডাক্তার সবার মধ্যে কী মিল আছে সেটা বের করা।

ডাক্তারের সঙ্গে কৃষকের মিল? ক্যাসভাসারের সঙ্গে ব্যাংকারের?

আমার মাথায় তো বাজ্রপাত হয়ে গেল!!!

(আমার বুয়েট জীবনের স্মৃতিচারণ পড়, পড়, পড় এ ডিসেম্বরে প্রকাশিত হবে ইনশা আল্লাহ। মাঝে মধ্যে তার কিছুটা অংশ এখানে শেযার করি এই আশায় যে কোন ভুল হলে সহপাঠীরা সেটি ঠিক করে দেবে)

 

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version