আমাদের এডা লাভলেসের খোঁজে

Spread the love

আমরা যখন ছোট, তখন আমাদের প্রিয় ব্যান্ডদলের একটির নাম ছিল – বনি-এম। তাদের এাটা গান ছিল – বাই দ্যা রিভার্স অব ব্যবিলন। একটা ছিল লা লা রাসপুতিন এরকম আরো অনেক গুলো। বাই দ্যা রিভার্স অভ ব্যবিলনের একটা চাঁটগাইয়া ভার্সনও আমরা তৈরি করেছিলাম যা ছিল অনেকটা এরকম –

বাই দ্যা রিভার্স অব ভাইট্টারি

আঁরো বাড়ির পিছদি, শুক্কুর মিয়ার বাড়ি।

শুক্কুর মিয়ার এক ডজন পোলাপান এ ডজন পোলা পান

বেইন্যা ফজরত,,, ইত্যাদি ইত্যাদি।

যাকগে বনি এমের কথা টেনে আনা আসলে গানের জন্য নয়। বরং বাই দ্যা রিভার্স অব ব্যবিলনের নামের কবিতার কবি জর্জ গর্ডনের কথা মনে পড়েছে। জর্জ গর্ডন অবশ্য বেশি পরিচিত লর্ড বায়রন নামে। তো, কবিদের সঙ্গে গণিত প্রেমীদেরও যে প্রেম ভালবাসা হতে পারে তার প্রমাণ হল বায়রনের স্ত্রী এনাবেলা। তাদের সংক্ষিপ্ত বিবাহকালের একমাত্র সন্তান একটি মেয়ে, অগস্টা এডা। অগস্টা বা সংক্ষেপে এডার জন্ম আজ থেকে ঠিক দুইশ বছর আগে, ১৮১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর।

এডার জন্মের একমাসের মাথায় এনাবেলা লর্ড বায়রনের গৃহ ত্যাগ করে তার বাপের বাড়ি চলে যান। সে সময়কার ব্রিটিশ আইন সেপারেশনের সময় স্বামীদের পক্ষে ছিল। কিন্তু বায়রন নিজের মেয়েকে তার কাছে রাখার চেষ্টা করেননি। বাবার সঙ্গে মেয়ের আর কখনো দেখাও হয়নি।

মেয়েটি যেন বাপের মত উড়নচন্ডী কবি না হয় সে জন্য তার মা শুরু থেকে সচেতন ছিলেন। যদিও নিজে এডাকে সময় দিতেন কম। কাজে এডা বড় হয়েছে নানী জুডিথের কাছে।এডাকে বিজ্ঞান, যুক্তি আর গণিতের এক কঠিন বেড়াজালের মধ্যে বড় হতে হয়েছে। তাঁর মনোজগতের গঠনটা বোঝা যাবে যখন কী না আমরা দেখি তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হল সেই সময়কার সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত নতুন নতুন সব যন্ত্রপাতির স্কেচ। এডা আবার নিজেও ছোটখাটো যন্ত্রপাতি বানাতে ভালবাসতেন। সময়টাও সুন্দর। প্রতিদিনই নতুন কিছু না কিছু আবিস্কার হচ্ছে।

ছোটবেলাতে এডার শরীর-স্বাস্থ্য ভাল ছিল না। প্রায়শও অসুস্থ হতেন। ৮ বছর বয়সে প্রবল মাথাব্যাথায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণহয়ে পড়ে। ১২ বছর বয়সে তাঁর আকাশে ওড়ার শখ হয়। সে সময় নানান বই পত্র ঘেটে পাখা তৈরির কাজও সে করেছে। যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁর আর ওড়া হয়নি। ১৪ বছর বয়সে হামে আক্রান্ত হয়ে এডার প্যারালিসিস হয়ে যায়। এ সময় প্রায় বছর খানেক তাঁকে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। ১৮৩১ থেকে ক্রাচে ভর দিয়ে হাটতে শুরু করেন। ১৯৩৩ সালে গৃহশিক্ষকের প্রেমে পড়ে তার সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে যান। কিন্তু গৃহশিক্ষকের আত্মীয় স্বজনরা তাঁকে আবার তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে যায়!

এডা লাভলেস

এই সময় বিজ্ঞান লেখক মেরি সমারফিল্ড এডার গৃহশিক্ষক হোন। এডার সঙ্গে তার সম্পর্কটি হয়ে উঠে হৃদ্যতাপূর্ণ। মেরি তাকে পরিচয় করিয়ে দেন চার্লস ব্যাবেজের সঙ্গে। শুধু চার্লস নয় এই সময় তার পরিচয় হয় অ্যান্ড্রু ক্রস, স্যার ডেভিড ব্রিউস্টার, চার্লস হুউটস্টোন, চার্লস ডিকেন্স এবং মাইকেল ফ্যারাডের সঙ্গে। ততোদিন ক্র্যাচ আর লাগে না। আড্ডাগুলোতে এডা ভাল নাচতেন এবং তাতে সবাই চমকিতও হতো।

সে সময় ব্যাবেজ ছিলেন অক্সফোর্ডের লুকাসিয়ান প্রফেসর (এই পদে ছিলেন নিউটন এবং হকিং)। ব্যাবেজ সে সময় তার “শেষ না করা” বিরাট গণণা যন্ত্রের জন্য সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। এডার যন্ত্র বানানো ও বোঝার ব্যাপারটা ব্যাবেজের সঙ্গে এসে একটা পরিণতি পায়। ব্যাবেজের সঙ্গে তার গভীর একাডেমিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

এ সময় ১৯ বছর বয়সে, এডার বিয়ে হয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের উইলিয়াম কিং-এর সঙ্গে। কিছুদিন পর ১৮৩৮ সালে ইংলন্ডের রাজা উইলিয়াম কিংকে আর্ল অব লাভলেস উপাধিতে ভূষিত করেন। আমাদের এডা লেডি এডা কিং থেকে হয়ে যান কাউন্টেস অব লাভলেস এবং কালক্রমে এডা লাভলেস। সেই থেকে তিনি এডা লাভলেস নামেই পরিচিত।

দি এনালিটিক্যাল ইঞ্জিন

চার্লস ব্যাবেজের  নিজের বানানো ডিফারেনসিয়াল ইঞ্জিনে আরো গিয়ার-টিয়ার যোগ করে সেটিকে একটি এনালিটিক্যাল ইঞ্জিনে পরিণত করার প্ল্যান ছিল। পাঞ্চকার্ড দিয়ে এটিকে চালানোর একটা ব্যাপারও ছিল। ডিজাইনটা ঠিক হলেও বানানো কিন্তু হয়নি।

১৮৪২ সালে এডা ইতালীয় গণিতবিদ লুইগি মেনাবেরার এনালিটিক্যাল ইঞ্জিন সংক্রান্ত একটি নিবন্ধ অনুবাদ করেন ইংলন্ডে প্রকাশের জন্য। অনুবাদটি দেখে ব্যাবেজ এডাকে অনুরোধ করে যেন সে এটিকে আর বড় করে সম্পূর্ণ করে কারণ “এডা এই মেশিনটাকে খুবই ভাল জানে”। কাজে অনুবাদটি হয়ে ওঠে মূল লেখার তিনগুন। সঙ্গে থাকে ঐ মেশিনের ব্যবহার কেমন হবে তার বিবরণ। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এই নিবন্ধে তিনি গানের স্বরলিপির মত সংকেত ব্যবহার করে এনালিটিক্যাল ইঞ্জিনকে কীভাবে প্রোগ্রাম করতে হবে তার বিশদ বর্ণণা দেন। সেই সঙ্গে লিখেন বেশ কয়েকটি প্রোগ্রাম। যদিও ব্যাবেজের লোকেদের ঐ মেশিনটি চালানোর ব্যাপারে ধারণা ছিল, কিন্তু এডার “Sketch of the Analytical Engine, with Notes from the Translator”  হলো প্রথম প্রকাশিত নিবন্ধ যেখানে প্রোগ্রাম করে যন্ত্র চালনার কথা প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। এই জন্য লেডী এডা লাভলেসকে আমরা এখন বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামার হিসাবে জানি। তাঁর গাণিতিক দক্ষতা ওবং প্রো্গ্রামিং-এর নোটেশন ব্যবহারের উচ্ছসিত প্রসংশা করতেন ব্যাবেজ।

মাত্র ৩৬ বছর বয়সে এডা তিন সন্তানকে রেখে মারা যান।

তারপর প্রায় শ’খানেক বছর চার্লস ব্যাবেজের এনালিটিক্যাল ইঞ্জিনের কথা সেভাবে সামনে আসে নাই। লাইব্রেরিতে বসে আধুনিক কম্পিউটারের জনক এলান তুরিং যখন হতাশ হয়ে নানান পেপার পড়তেন, তখন একদিন তিনি এডা লাভলেসের এই পেপারটি খুঁজে পান। তুরিং-এর মাথা তো তৈরিই ছিল। এডার পেপার সেখানে আগুন লাগিয়ে দেয় আর আমরা পেয়ে যাই আমাদের কম্পিউটার যন্ত্র। যার কারণে সভ্যতার ইতিহাস এন দুইভাগে বিভক্ত – কম্পিউটারের আগে ও কম্পিউটারের পরে।

গণিত, বিজ্ঞান, উদ্যোক্তা ইত্যাদি নানান দোকানের ভারে আমি যখন পিস্ট তখন সুবিন, মাহমুদ, ওয়াসি, রাফি- এদের পাল্লায় পড়ে আমি আর একটা পার্শ্ব দোকানের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছি। দেশে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-কে জনপ্রিয় করার জন্য যারা চেষ্টা করে যাচ্ছে, তাদের পাশে দাড়াতে। এই কাজ করতে গিয়ে দেখলাম কম্পিউটার নিয়ে স্নাতক পর্যায়ে পড়ে এমন ৪০ হাজার ছেলেমেয়ের মধ্যে মাত্র ৭% প্রোগ্রামার হতে চায়। আর মেয়েদের মধ্যে এটা ১%-এরও কম।

বৃষ্টি শিকদার এখন পড়ছে এমআইটিতে

ভাবলাম যত কার্যক্রম হচ্ছে তার সঙ্গে দুইটা কার্যক্রম যোগ করা যায়। একটা হল হাইস্কুল পর্যায়ে প্রোগ্রামিং কে জনপ্রিয় করা। আর এজন্য প্রতিযোগিতা, প্রশিক্ষণ আর বই লেখার ব্যবস্থা করা। আল্লাহর অশেষ রহমতে হাইস্কুল প্রোগ্রামিং কনটেস্টটা শুরু হয়ে গেছে। সুবিনের পর আরো অনেকেই বই লিখছেন। প্রোগ্রামিং কেন করা দরকার তা নিয়েও আলাপ আলোচনা বাড়ছে।
এর মধ্যে দেশ আসে আমাদের বৃষ্টি শিকদার। বৃষ্টি ২০১২ সালে আইওআইতে বিশ্বের হাইস্কুল ছাত্রীদের মধ্যে সেরা প্রোগ্রামারের কৃতিত্ব অর্জন করেছে। তার চেষ্টায় আমরা ঢাকায় মেয়েদের জন্য প্রোগ্রামিং ও এলগরিদমের একটা কর্মশালা করলাম।

তারপর থেকে এই কাজটাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা ভেবে যাচ্ছি, ছোট ছোট পদক্ষেপ নিচ্ছি। এসিএম আইসিপিসির এবারের ঢাকা সাইটে অন গার্লস টিমকে যেন ওয়াইন্ড কার্ড দেওয়া হয় সেজন্য একদিন আবু এল হক স্যারকে অনুরোধ করলাম। স্যার সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন।

তারপর আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম মেয়েদের জন্য এটা প্রোগ্রামিং কনটেস্ট (ন্যাশনাল গার্লস প্রোগ্রামিং কনটেস্ট-এনজিপিসি)-এর কাজ। প্রথমে আমরা ঠিক করলাম এটা হবে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ, মানে এডা লাভলেসের জন্মদিনে। কিন্তু দিনটি বৃহস্পতিবার। কাজে প্ল্যান আমরা পরিবর্তন করলাম। কারণ শনিবারে যদি করা যায় তাহলে অনেক সুবিধা থাকে।
আজে আমাদের ন্যাশনাল গার্লস প্রোগ্রামিং কনটেস্টটা হবে আগামীকাল, ১২ ডিসেম্বর, শিনবার, ঢাকায়।
প্ল্যানিং-এ আমরা ২০টা দলের কথা ভেবেছিলাম। এখন টিম হয়েছে ৬০ এর বেশি। আমাদের বড় স্পন্সর নাই। কাজে খুবই ছোট্ট আকারে এনজিপিসি হবে। তবে, আমি জানি, ইনশা আল্লাহ একদিন এটাও অনেক বড় হবে, সারাদেশে কয়েকস্তরের প্রতিযোগিতা করে আমাদেরকে খুঁজতে হবে আমাদের এডাকে।

  • যারা আসতে চান অনুষ্ঠঅনে তারা সরাসরি চলে আসতে পারবেন। ঢাকার সোবহানবাগে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সিএসই বিল্ডিং-এর ৬টা ল্যাবে সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে কার্যক্রম। সোয়া ৯টা থেকে বারোটা পর্যন্ত কনটেস্ট। দুপুর ২টা থেকে পুরস্কার বিতরনী যাতে যারা ঢাকার বাইরে যাবে তারা যেন ঠিকমতো চলে যেতে পারে।
  • আমি কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ও তার নির্বাহী পরিচালককে আমাদের ক্ষ্যাপাটেপনায় নিরন্তর সঙ্গে থাকার জন্য। আর সে সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই আমাদের স্পন্সর ও পার্টনারদের।
  • কম্পিউটার বিজ্ঞান শিক্ষা সপ্তাহের অংশ হিসাবে এই আয়োজন। বিস্তারিত এখানে দেখা যাবে।

 

সবার জীবন পাই-এর মত সুন্দর হোক।

 

 

 

2 Replies to “আমাদের এডা লাভলেসের খোঁজে”

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version