একটি শাদা বিপ্লবের প্রতীক্ষা

Spread the love

রাতের বেলা এককাপ দুধ খাওয়াটা আমাদের মনে হয় পারিবারিক একটা রীতি। আমি বড় হয়েছি একান্নবর্তী পরিবারে। আমার দাদা মৌলভী আহমদ চৌধুরী আমার দেখা প্রথম আধুনিক মানুষ। তাঁকে দেখতাম প্রতিদিন সকালে একটা সিদ্ধ ডিম এবং রাতে এক কাপ দুধ খেতে। মনে হয় তাঁকে দেখেই আমার ডিম-দুধ খাওয়ার অভ্যাসটা হয়েছে। এখন ডাক্তার বেশি ডিম খেতে দেয় না তাই ডিমের চলটা কম। কিন্তু দুধের ব্যাপারটা এখনো আছে।
এটি আমার অভ্যাসের অংশ হয়ে যাওয়ায় আলাদা করে দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা কখনো খেয়াল করিনি। প্রথম করি ১৯৯৮ সালে।
বাবাকে নিয়ে গিয়েছি ব্যাঙ্গালোরে। আমাদের এখানে যে রকম রাস্তায় অনেক চায়ের দোকান, সেখানেও তাই। তবে, দেখলাম ওরা চা খাচ্ছে না। খাচ্ছে দুধ বা ফলের জুস। বুজলাম ওদের মাথা কেন এত পরিস্কার। ব্যাঙ্গালোরে আরো একটা ব্যাপার চোখে পড়ল – আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই খুব ভোরে ওঠে এবং ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল সেরে ফেলে! আমাদের এখানে এই অভ্যাসটা এখনো মনে হয় সবার হয়নি।
তো বলছিলাম দুধের কথা। আমাদের যারা দুধ খেতে চায় না তাদের সঙ্গে দুধের পরিচয় হতো আগে পাটিগণিতের অনুপাতের অংক করার সময়। সেখানে শেখানো হত এক মন দুধে কত সের পানি মেশালে ৫০টাকা লাভ হবে!!! (আচ্ছা এখনকার বই-এ কি এই অংকগুলান আছে)?
যাকগে, দুধের ব্যাপারটা গতকাল আবার স্টার ম্যাগাজিনের কারণে খেয়াল করলাম। আমাদের মাথাপিছু দৈনিক দুধ খাওয়ার পরিমাণ হচ্ছে ৫৫ মিলি। অন্যদিক আমাদের প্রতিবেশিদের হিসাব হচ্ছে এরকম –
নেপাল ১৪০
শ্রীলংকা ১৪২
মালদ্বিপ ১৮৮
ভারত ২২৭
পাকিস্তান ৫২০
পুস্টিবিদদের হিসাবে এটি প্রতিদিন ২৫০ মিলি হওয়া দরকার। সাকিব আল হাসান কিছুদিন আগে এই কথাটা বলেছেন যদিও সেটি নিয়ে অনেক হৈচৈ হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশে কী আমরা দুধের চাহিদা মেটাতে সক্ষম?

আশ্চর্য হলেও সত্য যে, সব ধরণের হিসাব বলছে আমাদের গড় যদি আরো ৫গুন বাড়ে তাহলেও আমরা আমাদের নিজস্ব যোগান তৈরি করতে পারবো। কিছু বেসিক কাজ করতে হবে।
আমাদের দেশে গরু-ছাগলের খামার সেই অর্থে ব্যপকভাবে হয়না। অনেকে ভাবে এটি জটিল কাজ। আমি জানি না আমাদের এমন কোন গ্রাম আছে কী না যেটিকে শ্বেত গ্রাম বলা যায়। মানে, সেখানে প্রত্যেক ঘরে ঘরে গরু আছে এবং সকালে দুধ চলে যায় বড় বাজারে। দুধ নাকি দোয়ানোর পর মাত্র ঘন্টা চারেক ঠিক থাকে। এর মধ্যে সেটিকে আপনার প্রিজার্ভ করার ব্যবস্থা করতে হবে। নাহলে সেটা নষ্ট।
ঠিক এই জায়গাটাতে কাজ করেছিলেন এক ভারতীয়, আজ থেকে ৬৫ বছর আগে। ভার্গেস কুরিয়েন নামের এই ভদ্রলোককে বলা হয় ভারতীয় সাদা বিপ্লবের কর্নধার। ১৯৪৯ সালে তিনি কয়েকজন গরুর খামারীকে একটি চিলার কেনার কথা বলেছিলেন।
অথচ পড়েছেন মিশগান বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। দেশ ফিরে হলেন সরকারি করণিক। ১৯৪৯ সালে ঘটনাচক্রে একটি সমবায় সমিতির জেনারেল ম্যানেজার হয়ে গেলেন। সমিতির সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করলেন ৬০ হাজার রুপী দিয়ে একটি পাস্তুরিত করার মেশিন কিনতে। এবং খুব তাড়াতাড়ি সেটার দাম ওঠে গেল কারণ দুধ পাঠানো যাচ্ছিল বোম্বেতে। সেই থেকে অন্যরাও এই দিকে আকৃষ্ট হলো এবং ভারত হয়ে উঠলো বিশ্বের এ নম্বর দুধ উৎপাদনকারী দেশ!!!

মিল্ক ভিটা শহরে দরকারের ৭০% এর যোগানদার

ভারত যা পেরেছে, সেটা আমরাদের দেশেও সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সেজন্য নানান ধরণের উদ্যোগ দরকার যার মধ্যে রয়েছে দুধ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, দুগ্ধজাত সামগ্রীর যে বাজার ইতোমধ্যে হাতছাড়া হয়েছে সেটি পুনরুদ্ধারের জন্য ঝাপিয়ে পড়া, উদ্যোক্তাদের পাশে সরকার আর বেসরকারি লোকেদের দাড়ানো এবং এনিম্যাল হাছভেন্ট্রির গ্র্যাজুয়েটদের এই কাজে মনোযোগ দেওয়া।
কাল ডেইলি স্টারের ঐ লেখা থেকে আরো একটা বিষয় জানলাম। আমি দেখেছি আমাদের দেশে গোয়ালা আগে দুধ দোয়ানোর কাজটা করে পরে বাছুরকে খেতে দেয়। কিন্তু কাজটা নাকি উল্টো হওয়া দরকার। বাছুর হওয়ার ২ মাস পরেই আমার গাভীকে গর্ভবতী করা দরকার। তাতে বছর বছর বাছুরের ব্যাপার এবং দুধের যোগান দুইটাই ঠিক থাকে।

 

এই খাতে ছোট উদ্যোক্তারা কত জায়গাতে কাজ করতে পারেন-

১. খামার – গরুর খামার করাটা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। চার গাভী খামার নামে একটি কমপ্লিট প্রজেক্ট করা আছে গ্রামীণ ব্যাংকের এখনকার চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হকের। সেটার হিসাব নিকাশ বলে একটি ছোট সমন্বিত খামার করাটা কঠিন হলেও সেটি অসম্ভব নয়। উদ্যোম আর কিছু টাকা পয়সা দরকার।

২. বিপনন ও বিতরণ : এখনো অনেক স্থানে খামারী বা কৃষকের গরুর দুধ ঠিকমতো বাজারে এসে পৌছায় না। যে দুধ ৭০-৮০ টাকা লিটার বিক্রি হওয়ার কথা সেটি স্থানীয় বাজারে ৩০-৪০টাকায় কৃষক বিক্রি করে দেয়। এক্ষেত্রে বড় শহরে দুধের যোগান দেওয়ার একটা বুদ্ধি করা যায়। দরকার হবে একটা চিলার/পাস্তুরাইজড মেশিন আর একটা ব্যাকইয়ার্ড লিংকেজ। বেচার ব্যাপারটা আমি মোটেই ভাবছি না কারণ বাজার অনেক বড় (বর্তমানের চেয়ে পাঁচগুন বড় হতে পারে)

৩. দুগ্ধজাত সামগ্রী – বাটার, পনির, দই ইত্যাদি নানান রকমের পণ্য উৎপাদনে যুক্ত হওয়া।
দুধের ব্যাপারটাকে ঠিকমত ধরতে পারলে দেশের দুইটা লাভ – স্বাস্থ্যবান জাতি এবং সফল উদ্যোক্তা।

 

 

কে শুরু করতে চায়?

9 Replies to “একটি শাদা বিপ্লবের প্রতীক্ষা”

  1. চিলার টা হচ্ছে দুধ টা ঠাণ্ডা করা মেশিন। এতে কোন প্রকার কেমিক্যাল ব্যবহার না করে শুধু ঠাণ্ডা করে দুধ সংরক্ষণ করা যায়। এটা ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল সাইজ হতে পারে। ক্যাপসুল গুলো প্রান চীন থেকে নিয়ে আসে । এখন দুটোই দেশে বানান হয়। এগুলোর দাম লিটার ভেদে ২ লাখ থেকে ৪.৫ লাখ পর্যন্ত আছে।
    আর কেউ যদি স্বচক্ষে দেখতে চান তবে পশ্চিম কাজীপাড়া, মিরপুর চলে আসেন…

    1. সুমন ভাই চিলার দেখার খুব ইচ্ছা আছে, মিরপুর পশ্চিম কাজীপাড়াতে কি আপনার চিলার আছে।
      যদি আপনার চিলার থাকে বা আপনার পরিচিত কারো থাকে তাখলে একদিন এসে একটু বেরিয়ে যেতাম।
      আর এই চিলার কোথা থেকে কিনা যায় এবং কয়েকটা সাপ্লাইয়ার এর ঠিকানা দিলে অনেক সুবিধা হত।
      আপানর মোবাইল নাম্বারটা দিলে একদিন কথা বলতাম।
      আমার মোবাইল নাম্বার – (+৬৫৯১৭৪০৪৬৬)

  2. স্যার, আমি এই ব্যাপার টাতে খুবই আগ্রহী কিন্তু যখন বাজারজাত করার কথা চিন্তা করি, তখনই পিছিয়ে যাই। এখন জানলাম চিলার এর সমাধান। তাই চিলার ও চিলারের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত জানালে উপকার হবে।

  3. স্যার আমি গরিব ঘড়ের সন্তান ছোট সময় থেকেই গরু, ধান চাল এইগুলির সাথে আমার খুব ভাল একটা পরিচয় আছে ”উদ্যোক্তা গ্রুপে” আমার এক বন্ধু প্রানতোষ পালের গরুর খামার নিয়ে একটা লিখা শেয়ার করেছিলাম।
    এইরকম একটা খামার করার আমারও অনেক ইচ্ছা, আশা করি আপনি ”চিলার/পাস্তুরাইজড মেশিন” সম্পর্কে একটু বিস্তারিত লিখবেন।
    চিলার করতে কেমন খরচ হয়?
    মেশিন পত্র কোথা হতে আনতে হয়? কত লিটার দুধ হলে নিজেই একট চিলার করা ভাল হয়?
    একটু বিস্তারিত আপনার নিকট আশা করছি।

    আশা করি শাদা বিপ্লবের আমিও একজন সহযুদ্ধা হব।

  4. এটা আমি রংপুরে এবার দেখেছি। ওখানে সাতমাথা – মাহিগঞ্জ এলাকায় অন্তত ৭/৮টি চিলার আছে। ব্যাপারটা এমন হয়েছে যে, চিলারকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গাভী পালন শুরু হয়েছে আবার দুগ্ধ উতপাদনের পরিমান বেড়ে যাওয়ায় নতুন চিলারের চাহিদা তৈরি হয়েছে। যা ৫ বছর আগে ছিল না। এখন অনেক শিক্ষিত ছেলে মেয়েরাও গাভী পালন করছে।

    1. Mahbub Ratan ভাই চিলার যদি আপনি আবার কখনো ঐ এলাকায় যান আশা করি চিলার সম্পর্কে একটু বিস্তারিত শেয়ার করবেন। এই ব্যাপারে আমার খুব একটা আগ্রহ আছে কিন্তু তেমন কোন ইনফর্মেশন নেই শুরু করার মত অথবা কাওকে দিয়ে শুরু করানোর মত।

Leave a Reply Cancel reply

Exit mobile version